গ্রামীণ গল্পনির্ভর পালানাট্য প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু পালাকারের জীবনীনির্ভর নাটক খুব একটা দেখা যায় না। পালাকারদের জীবনী সংরক্ষণের প্রবণতা কোনোকালে খুব একটা ছিল বলে মনে হয় না। ঔপনিবেশিক শাসনে পালানাট্য খুবই অবহেলিত হিসেবে চিহ্নিত। মধ্য যুগের শেষ পাদের জনপ্রিয় পালাকার মনসুর বয়াতির জীবনাখ্যান সম্প্রতি মঞ্চে উপস্থাপন করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। জাবির এ বিভাগ প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই দেশজ ধারার নাট্যরীতিকে বিশ্ব নাট্যধারায় প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতিশ্রুতিশীল। তাদের পঠন-পাঠন, গবেষণা ও প্রযোজনায় তা-ই প্রাধান্য পায়। এবার সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের 'বুকঝিম এক ভালোবাসা' অবলম্বনে নির্মিত এ নাটকের নামকরণ করা হয়েছে 'জল পলকের গান'। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন স্বনামধন্য নির্দেশক ড. ইউসুফ হাসান।

সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল মঞ্চে নাটকটি প্রদর্শিত হয়। এটি গ্রামীণ পালা আঙ্গিকে আধুনিক থিয়েটারের সব উপাদান-উপকরণে উপস্থাপন করেছেন নির্দেশক। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতির বর্ণনা, বন্দনা, অভিনয়-নৃত্য-গীত-গল্প ও চলনের অদ্বৈত মাধুর্যে নান্দনিক হয়ে উঠেছে পালাটি। মনসুর বয়াতি মধ্য যুগের জনপ্রিয় পালাকার। তাঁর সময়কাল আনুমানিক ১৮ শতক বলে ধরে নেওয়া হয়। বিশ শতকের শুরুর দিকে চন্দ্রকুমার দে হবিগঞ্জের বানিয়াচং থেকে 'দেওয়ানা মদিনা' নামে পালা সংগ্রহ করেন। এ পালার রচয়িতাই মনসুর বয়াতি। এ পালায় বানিয়াচংয়ের এক দেওয়ান পরিবারের কাহিনি বিবৃত হলেও মানবীয় প্রেমে অসামান্য হয়ে উঠেছে পালাটি। পালাটি সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রচলিত ছিল। পালাকার মনসুর বয়াতি জনপ্রিয়তা পেলেও তাঁর সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সৈয়দ শামসুল হক মনসুর বয়াতির চরিত্রনির্ভর কাল্পনিক ঘটনার সৌধ নির্মাণ করেছেন 'বুকঝিম এক ভালোবাসা' প্রেমাখ্যানে। মনসুর বয়াতির জীবনের একাকীত্ব, বিরহ-বেদনাই এ নাটকের প্রধান অঙ্গ।

এই নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয় যদি একটি বাক্যে প্রকাশ করতে হয় তাহলে আমরা বলতে পারি মধ্যযুগের বাংলায় বারো ভূঁইয়াদের শাসনকালের একটি বিয়োগান্ত ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনি এটি। প্রান্তিক মনসুর বয়াতি, যে গান বাঁধে আর গায়, তার প্রেমে পড়ে যায় প্রতাপশালী এক ভূঁইয়া মহব্বতজং-এর বোন চাঁদ সুলতানা। স্ত্রী নূরজাহানের আপত্তি সত্ত্বেও মহব্বতজং চাঁদের বিয়ে দিয়ে দেয় রাজা ফিরোজ শাহের সঙ্গে। আর মনসুরকে প্রাণে না মেরে বিষ খাইয়ে তাঁর কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেয়। ফিরোজ শাহ যখন জানতে পারে চাঁদ ভালোবাসে মনসুরকে, তখন সে উদ্যোগী হয় মনসুরের কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে দিতে, তথা প্রেমিক যুগলের মিলন ঘটাতে। কিন্তু মনসুর ও চাঁদ দু'জনেই মারা যায়। থাকে শুধু ফিরোজ শাহ মনসুরের শিষ্য আবুল, যে বয়ে নিয়ে চলে তার মৃত গুরুর গানের ধারা।

বয়াতির জীবনের এমন করুণগাথা নৃত্যগীত, অভিনয় ও চলনে উপস্থাপন হতে হতে কল্পনা-ইতিহাস থেকে উপস্থিত হয় চাঁদ সুলতানা, আবুল, হায়দার, মহব্বত জং, নূরজাহান কিংবা ফিরোজ শাহ। চরিত্রগুলোর ভারে যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে তৎকালীন সমাজ। প্রেম কিংবা শিল্পের মানবীয় রক্তক্ষরণে 'জল পলকের গানে' নাটকীয়তায় দগ্ধ হতে থাকে মনসুর বয়াতি। পালার বন্দনার স্টাইলের সঙ্গে নৃত্যগীত ও চলন আনন্দে যখন নাটকটি শুরু হয় তখন মঞ্চ যেন আনন্দে দুলতে থাকে। রং-আলো, নকশিকাঁথার সায়াক্লোমার সাজেশনে মঞ্চের পেছনে সংগীত-দোহার দলের তান আর বয়াতির বর্ণনায় মনসুর বয়াতির আবেগগুলো দর্শকের হৃদয় থেকে হৃদয়ে প্রেম-ভক্তি ও বিরহ বেদনায় মথিত হতে থাকে।

অপরূপ জমিদারকন্যা চাঁদ সুলতানাও মনসুর বয়াতির কাছে নিজেকে সমর্পণ না করে পারে না। চাঁদ সুলতানার অভিনয়ে যেন দর্শক কেঁদে কেঁদে ওঠে বারবার। ভালোবাসলেও কখনও কখনও পাশে থাকা যায় না। নিঃসঙ্গতা প্রতিটি জীবনের অনিবার্য। 'জল পলকের গান' নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সামিউল হক ভূঁইয়া, ফয়সাল আবির, সাজিদ উচ্ছ্বাস, অংশুমান রায়, হাজেরা আক্তার কেয়া, অন্তরা সাহা লাকি, কৃষ্ণা সজ্জন পূজা, বর্ষা বিশ্বাস, শহীদ মৃধা, মেহনাজ জাহান আনিকা, তুষার ধর, শহীদ মৃধা, রফিকুল ইসলাম মানিক, রিফাত খান অনিক, আব্দুল্লাহ আল রাকিব উর রহমান, নূর-ই নাজনীন, অসীম কুমার নীল, প্রণয় সরকার, সঞ্জয় ঘোষ, আশিকুর রহমান বন্ধন, আয়শা সিদ্দিকা জামান রুমানা, খায়রুন নাহার খান ফাহিম, তুলি সরকার, প্রশান্ত প্রসাদ স্বর্ণকার, আবির হাসান, ইগিমি চাকমা।