সুকির আত্মচিৎকারে প্রান্তিক গারো-মান্দি জাতিগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনা ও অস্তিত্বহীনতার যন্ত্রণা যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছিল শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটারের মঞ্চজুড়ে। নৃগোষ্ঠী জনপদ বিলুপ্তির শঙ্কায় দর্শক যেন নড়েচড়ে বসছিল। সম্প্রতি ঢাকার মঞ্চে 'বনপাংশুল' নাটকের অভিনয়ে দর্শক এমনই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছিল। প্রখ্যাত নাট্যকার সেলিম আল দীন রচিত এ নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থী খন্দকার রাকিবুল হক।

সেলিম আল দীনের 'বনপাংশুল' নাটকের আখ্যান গড়ে উঠেছে মধুপুর গড়ের বনাঞ্চলে বসবাসরত নৃগোষ্ঠী গারো-মান্দির জীবনসংগ্রামকে কেন্দ্র করে। আদিকাল থেকে যে বনভূমিতে বাস করছিল, হঠাৎ সে বন ধ্বংসে তারা হয়ে উঠেছিল অসহায়। ভূমি দখল, শোষণ, মহাজনি প্রথা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুণ্ঠনে সুকি, গুণীন, রাজেন্দ্র, মঙ্গলি, সোনামুখী, নৃপেন যেন মুক্তির পথ খুঁজে ফিরছিল। অনিলের জীবনসংগ্রাম কিংবা সুকির গর্ভজাত অনাগত সন্তান কি পূর্বপুরুষের বসতি রেখে যেতে পারবে! মান্দিদের জীবন, বিশ্বাস, রীতি-নীতি, জীবনের ট্র্যাজেডি অন্যতম শিল্পকুশলে অনবদ্য। নাটকের শেষে স্পষ্ট হয় ধর্ষিত সুকির গর্ভেই কালো মেঘের কাজল পরে আসছে আরেক বনপাংশুল।

খন্দকার রাকিবুল হক শিক্ষানবিশ নির্দেশক হলেও, শূন্য স্পেসে একটি জনপদের জীবনঘনিষ্ঠ শৈল্পিক যে আবহ যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা অতুলনীয়। অল্প বয়সী শিক্ষার্থীদের এত বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় যেন দর্শকদের নিয়ে গিয়েছিল সেই জনপদের জীবনের গভীরে। নাটকের দৃশ্য ইমেজগুলো ভালো লাগে। ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতিতে নৃত্য-গীত-অভিনয়-দ্বন্দ্ব অনবদ্যতায় অদ্বৈতসুরে উপস্থাপিত। আবহমান রীতির চারদিকে দর্শক বেষ্টিত মঞ্চরীতিতেই চরিত্র ও ঘটনার নানা আবেগ উপস্থাপিত। ধূপ-ধোঁয়া, লাইভ মিউজিকের তারুণ্যে অনবদ্য।

সুকি চরিত্রে তাছয়া লাভিব তুরা, অনিল চরিত্রে সাজ্জাদুল আলম শুভর সহজ-সরল অভিনয় দর্শককে ভাবিত করে। লুৎফর মাস্টার চরিত্রে এসএম মিনহাজুল ইসলামের স্বচ্ছন্দ কথোপকথন বাস্তববাদী চরিত্রেই প্রাণ সঞ্চার করে। আরও অভিনয় করেন- অর্ণব মল্লিক, হোসাইন জীবন, জান্নাত তাসফিয়া বাঁধন, জুয়াইরা মেহজাবীন, তন্ময় চন্দ্র রায়, মো. মেরাজুল ইসলাম, সাজ্জাদুল আলম শুভ, শৌমিক বাগচী, মোহাম্মদ রবিন মিয়া, মুস্তাসির বিল্লাহ খান অর্পণ, নূর-ই-নাজনীন, প্রজয় বকশী, তানভীর পালোয়ান অপূর্ব, রাহনুমা ইসলাম উইনি ও সিনথিয়া হাকিম দীপা। নাটকটি মধ্যযুগের পাঁচালি রীতির আধুনিক নব্য পাঁচালি। অভিনয়ে যেমন প্রাণ আছে, দৃশ্য নির্মাণে তেমনি সৃজনশীলতা রয়েছে। সংগীতের আবহ, বনের পরিবেশ, বর্ণনা, নৃত্য-গীত-অভিনয়ের অদ্বৈত সুরে এ নাটকের উপস্থাপনা।