বরেণ্য অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর এই বয়সেও এত প্রাণদীপ্ত অভিনয় করতে পারেন, তা সেদিন মঞ্চে দর্শক অভিভূত হয়ে দেখছিল। চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে কী যে বিশ্বাসের ছোঁয়া। স্বর ও বাচনের কী অপূর্ব খেলা। অভিব্যক্তিতে পরিমিতি; বহুমাত্রিক স্বরীয় প্রক্ষেপণ। আর সহ-অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহার অভিনয়ও যেন উসকে দিচ্ছিল চরিত্রের ভাবাবেগ প্রকাশে। ঢাকার মঞ্চে আসাদুজ্জামান নূর 'রিমান্ড' নামের এক মঞ্চনাটকে অভিনয় দিয়ে দর্শকমন কাড়লেন। জেরাভিত্তিক সংলাপনির্ভর 'রিমান্ড' রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন শুভাশিস সিনহা। গত ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আলী যাকের নতুনের উৎসবে নাটকটি প্রদর্শিত হয়।

'রিমান্ড' নাটকের মূলে আছে একজন লেখকের ব্যক্তিগত দর্শন। যিনি নৈরাজ্যবাদী। নিজস্ব মতাদর্শ প্রচার, ব্যক্তিক আদর্শ কিংবা আধিপত্যের জন্য মায়াজাল বিস্তার করে লেখায়। তরুণদের মধ্যে উসকে দেয় জীবন বিধ্বংসী নানা প্রবণতা। নানা অঘটনের পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দার জেরার সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। গোয়েন্দা কর্মকর্তার প্রশ্নাত্মক ধারায় ফুটে উঠতে থাকে লেখকের ভাবনাগুলো। নাট্যকার নৈরাজ্যবাদিতার এপিসটোলজিক্যাল স্বরূপসহ সাহিত্য-ইতিহাসের নানা উপাদান ব্যবহার করে তুলে এনেছেন লেখকের মনোদর্শনে। গোয়েন্দা কমকর্তা চান প্রেম-ভালোবাসা, মানবতাবোধ। যেখানে দৈহিক কামনা নয়; প্রেম-মমতাপূর্ণ সম্পর্কই জীবনকে পূর্ণতা দিতে পারে।

দ্বান্দ্বিক সংলাপের মধ্য দিয়ে দর্শককে নিয়ে যায় সমাজ বাস্তবতার আরেক গভীরতর বিশ্নেষণাত্মক অনুভূতিতে। নাটকটির উপস্থাপনে দৃশ্য নির্মাণের অতটা ক্যারিশমা নেই; যতটা ক্যারিশমা আছে চিন্তার ভাব-প্রকাশে। ক্যারিশমা আছে সংলাপের দ্বান্দ্বিক খেলায়। নাট্যকার লেখকের মনস্তত্ত্বকে আশ্রয় করে নৈরাজ্যবাদী বিধ্বংসী প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। বিপরীতমুখী দুটি চরিত্রকে দিয়ে নৈরাজ্যচেতনা, সমাজের ক্ষত, জীবনের নানা অনুষঙ্গ তুলে ধরেছেন। দুই চরিত্রের অনবদ্য অভিনয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী এক রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত তৈরি হয় মঞ্চে। পাশাপাশি মঞ্চে এসেছে কয়েকটি পার্শ্বচরিত্র।

আলী যাকের নতুনের উৎসবে অনুদানভিত্তিক পাঁচটি প্রযোজনার প্রথম উপস্থাপনটি ছিল 'রিমান্ড' নাটক। মঞ্চে নাটকটির শুরু হয় একজন লেখক-আসামিকে জেরার জন্য আহ্বানের মধ্য দিয়ে। একজন নারী গোয়েন্দা কর্মকর্তা প্রশ্ন করতে থাকেন। লেখকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি তরুণদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছেন। অন্যদিকে লেখক মনে করেন, পৃথিবীর মানবসত্তা মানেই আত্মসুখের সন্ধানে যাত্রা। আত্মপরিতুষ্টিতেই সে বাঁচে। প্রেম মস্তিস্কের বিভ্রম। বস্তুগত আত্মরতি জীবনের মূল। পুলিশের জেরায় ফুটে উঠতে থাকে লেখকের জীবনের নানা অস্বাভাবিক ঘটনা।

উন্মোচিত হয় লেখক মানব জন্মকে একজন নারী ও পুরুষের দৈহিক উল্লাসের ফল ছাড়া আর কিছুই ভাবেন না। তাদের কথায় আত্মহত্যা, প্রতারণা, পত্রিকার সম্পাদক, নেশাসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে। একসময় আবিস্কার হয় জেরাকারী কর্মকর্তাটি তারই ঔরসজাত মেয়ে। এক মানবিক অভিঘাত, আবেগিক মুহূর্ত ও দ্বান্দ্বিক রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে নাটকের সমাপ্তি ঘটে। নাটকের আলো পরিকল্পকের আলো-আঁধারি মঞ্চে যেন জীবনের গান ফুটে উঠছিল। খুব বড় ধরনের কোনো মঞ্চসজ্জা নেই। প্রচলিত রিমান্ডের মতো দুটো চেয়ার ও একটি টেবিল। প্রসেনিয়াম মঞ্চবিন্যাসের ইউরোপীয় দ্বন্দ্ব-নির্ভর রীতিতে বাস্তববাদী ধারায় নাটকটি উপস্থাপিত। সব মিলিয়ে অসাধারণ উপস্থাপনা।