সময়ের পালাবদলে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো হয়ে উঠেছে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। তবে ওটিটির বিভিন্ন আয়োজনের মধ্যে বেশি মনোযোগ কেড়েছে ওয়েব সিরিজগুলো। গল্পের বিষয়বৈচিত্র্য আর নান্দনিক নির্মাণের কারণে যা উঠে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এ সময়ের আলোচিত ওয়েব সিরিজগুলো নিয়েই এ আলোচনা। লিখেছেন রাসেল আজাদ বিদ্যুৎ

এত অল্প সময়ে আমাদের ওয়েব সিরিজগুলো দর্শক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসবে- তা হয়তো অনেকেই ভাবেননি। অবাক করা বিষয়- শুধু দেশি দর্শক নয়, বিদেশি দর্শকের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে একের পর এক সিরিজ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা যে কোনোভাবে পিছিয়ে থাকতে পারি না, প্রতিনিয়ত তার প্রমাণ দিয়ে চলেছেন দেশের আলোচিত ও তরুণ নির্মাতারা। দর্শক-প্রত্যাশা পূরণে যাঁরা একের পর এক বিষয়বৈচিত্র্যে ভরপুর গল্প আর নিরীক্ষাধর্মী নির্মাণ তুলে ধরছেন। অন্যদিকে অভিনয়শিল্পীরা বারবার নিজেকে ভেঙে নতুনরূপে পর্দায় তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দর্শকহৃদয়ে দাগ কাটতে ক্যামেরার সামনে ও পেছনের মানুষগুলো নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

যে কারণে সিনেমা ও টিভি নাটকের চেয়ে এখন বেশি আলোচনা শোনা যাচ্ছে ওটিটির আয়োজন নিয়ে। তার চেয়ে বড় বিষয়- ভালো কাজের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছে প্রতিটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। 'মহানগর', 'কারাগার', 'তাকদীর', 'ষ', 'সাবরিনা', 'নেটওয়ার্কের বাইরে', 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান', 'বোধ', 'দুই দিনের দুনিয়া', 'কাইজার', 'মরীচিকা', 'কন্ট্রাক্ট', 'জাগো বাহে', 'শাটিকাপ', 'বলি' থেকে শুরু করে 'গুটি' পর্যন্ত দেশীয় নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীদের বেশ কিছু ওয়েব সিরিজ ও ছবি দর্শক প্রশংসা কুড়িয়েছে। যদিও শুরুর দিকে বেশিরভাগ সিরিজে অপরাধজগতের গল্পই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে এখন সেখান থেকে সরে এসে নানা ধরনের গল্প নিয়ে তৈরি হচ্ছে একেকটি সিরিজ। যে কারণে নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং শিল্পীরাও এখন পা রাখছেন ওয়েব দুনিয়ায়, যার সুবাদে আরও বর্ণিল হয়ে উঠছে দেশীয় ওয়েব সিরিজগুলো।

এবার একটু ওয়েব সিরিজ ও ওয়েব ছবির গল্পের দিকে নজর দেওয়া যাক। শিহাব শাহীনের 'আগস্ট ১৪' ও রায়হান রাফির ওয়েব ছবি 'জানোয়ার'-এ আমরা নির্মম বাস্তবতার চিত্র দেখতে পাই। খবরে প্রকাশিত ঘটনা থেকে আমাদের কল্পনা যে চিত্র তৈরি করে নেয়, তা থেকে চোখে দেখা ঘটনা কতটা আলাদা হতে পারে- তারই উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে এ দুটি সিরিজ ও ছবিতে। অন্যদিকে আশফাক নিপুণের 'মহানগর' কাল্পনিক ঘটনার বয়ান হলেও তা যাপিত জীবনে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতার ছায়া তুলে ধরে। মোশাররফ করিমের অনবদ্য অভিনয় দর্শককে বুঝতে দেয়নি এ কেবলই গল্প। একই নির্মাতার 'সাবরিনা' সিরিজে আমরা দেখতে পাই দুই নারীর নতুন এক আখ্যান। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তাঁর 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান' সিরিজে তুলে ধরেছেন নারী-পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা এবং পুরুষশাসিত সমাজের এক কঠিন সত্য। সেই সত্য অনিন্দ্য অভিনয় দিয়ে দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন তাসনিয়া ফারিণ ও অন্য শিল্পীরা। অনম বিশ্বাসের 'দুই দিনের দুনিয়া' সিরিজে গল্প রচিত হয়েছে পীর-ফকিরের নানা কিংবদন্তির আলোকে।

যে কারণে বহুবার বহুভাবে পর্দায় তুলে ধরা অপরাধ আর শাস্তির গল্পের সঙ্গে দুই দিনের দুনিয়ার গল্প মেলানো যায় না। এ জন্য চঞ্চল চৌধুরী, ফজলুর রহমান বাবু, মৌসুমী হামিদসহ সিরিজের প্রতিটি চরিত্র মনে হয় অনেক দিনের চেনা; চোখে দেখা রক্তমাংসের মানুষ। অন্যদিকে তামিম নূর ও কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের 'কন্ট্রাক্ট', শিহাব শাহীনের 'মরীচিকা'সহ বেশ কিছু সিরিজ সিনেমাপ্রেমীদের তৃষা মিটিয়েছে। পাশাপাশি মিজানুর রহমান আরিয়ানের ওয়েব ছবি 'নেটওয়ার্কের বাইরে' ছিল প্রচলিত সিনেমার ধারা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নতুন উদাহরণ। শঙ্খ দাশগুপ্তের 'বলি'-তে আমরা পেয়েছি ক্ষমতার লড়াইয়ে মেতে ওঠার নতুন এক গল্প। আবার পুরোপুরি ভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করতে দেখা গেছে বেশ কিছু নির্মাতাকে। চিরায়ত ভৌতিক গল্পকেও যে নতুনভাবে পর্দায় তুলে ধরা যায়, তার প্রমাণ মেলে নুহাশ হুমায়ূনের 'ষ' সিরিজ দেখে।

একইভাবে দর্শককে চমকে দিয়ে সৈয়দ আহমেদ শাওকী তাঁর দুটি সিরিজ 'তাকদীর' ও 'কারাগার'-এ উপস্থাপন করেছেন নতুন স্বাদের দুই গল্প। যেখানে চঞ্চল চৌধুরী, আফজাল হোসেন, ইন্তেখাব দিনারের মতো অভিনেতাদের দর্শক আরও একবার ভিন্নরূপে আবিস্কারের সুযোগ পেয়েছেন। অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনকেও নতুনরূপে দেখা গেছে শঙ্খ দাশগুপ্তের 'গুটি' সিরিজে। এভাবেই একেকটি সিরিজের একেক ধরনের গল্প দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। বাড়িয়ে দিয়েছে ওয়েব সিরিজের ক্ষুধা। এ জন্য ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো একটি সিরিজের এক সিজন শেষ হতে না হতেই ঘোষণা দিয়ে চলেছে নতুন সিজনের। দর্শকরাও গুনে চলছেন প্রতীক্ষার প্রহর।

এখন কথা হলো, ওয়েব সিরিজের এই উত্থানের পেছনে কারণ কী? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাতারা বড় বাজেটে স্ব্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন, যার সুবাদে সাহসী হতে পারছেন বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সৃষ্টির নেশায় মেতে ওঠার। তবুও ঘুরেফিরে অপরাধের গল্পই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। এর কারণ কী হতে পারে? নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিম বলেন, 'শুরুতে গল্প নির্বাচনে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে, তা থেকে আমরা কিন্তু সরে আসছি। প্রথমে আমাদের প্রয়োজন ছিল দর্শকের কাছে নাটক, টেলিছবি ও ওয়েব সিরিজের পার্থক্য তুলে ধরা। এরপর যেখানে বৈচিত্র্য যোগ করা। শুরুতে কী প্রাধান্য পেয়েছে তা মুখ্য নয়। বরং প্রতিটি ধাপ কীভাবে অতিক্রম করছি, সেটিই দেখার।'


আশফাক নিপুণ
টেলিভিশনের সঙ্গে ওটিটির কোনোভাবেই তুলনা চলে না। প্রথম কারণ, টেলিভিশন ফ্রি মিডিয়া, পরিবারের সবার সঙ্গে বসে দেখা হয়। সেখানে যা কিছু প্রচার হয়, তা বেঁধে দেওয়া নীতিমালা মেনে নির্মিত। অন্যদিকে ওটিটি পারসোনাল মিডিয়া, যা দেখার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। এটা তাদের পক্ষেই সম্ভব, যারা প্রাপ্তবয়স্ক, অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য রাখে। এ জন্য গল্প নির্বাচন থেকে শুরু করে নির্মাণসহ ওটিটির প্রতিটি আয়োজনে দর্শক প্রত্যাশার কথা মাথায় রাখতে হয়। দ্বিতীয় কারণ, টেলিভিশন বা সিনেমা নির্মাণে যে সেন্সরশিপের কথা মাথায় রাখতে হয়, ওটিটিতে তার বাধ্যবাধকতা নেই। তাই যেসব গল্প টিভি বা সিনেমায় তুলে ধরতে পারিনি, সেটা ওয়েব সিরিজ বা ওয়েব ছবিতে অনায়াসে তুলে ধরতে পারছি। বাজেট, নির্মাণ স্বাধীনতা, গল্পে বিষয়বৈচিত্র্য তুলে ধরার সুযোগ- এগুলোই ওটিটির অন্যান্য মাধ্যমে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।



অনম বিশ্বাস
ওটিটির উত্থানের বড় কারণ, ভালো কাজের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারা। দেশীয় ওয়েব সিরিজ ও ওয়েব ছবিতে আমরা যেমন ভালো গল্প পাচ্ছি, তেমনই এর নির্মাণেও খুঁজে পাচ্ছি নান্দনিকতার ছাপ। মাঝে টিভি নাটকগুলোয় বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া গেলে সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ গুণী নির্মাতা অনেকে এই মাধ্যম থেকে ধীরে ধীরে সরে গেছেন। সিনেমার ক্ষেত্রেও দেখা যায়, অনেকদিন পরপর একটি-দুটি করে সিনেমা দর্শক আলোচনায় আসছে। বাকি সময়টা উল্লেখ করার মতো কিছু থাকছে না। অন্যদিকে ওটিটি দর্শক প্রত্যাশা পূরণে নানা ধরনের গল্প তুলে আনছে। নির্মাতারাও চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। অনেকটা নিজের সঙ্গে নিজে প্রতিযোগিতা করে, যাতে করে সময়কে ছাপিয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যায়। এ মানসিকতাই ভালো কাজের ভিত গড়ে দিয়েছে।



নুহাশ হুমায়ূন
বিশ্বজুড়ে বিনোদনমাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় ওভার দ্য টপ [ওটিটি]। মানুষ এখন টাকা দিয়ে ঘরে বসেই সিনেমা দেখায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক নির্মাতা তাঁদের কাজ ছড়িয়ে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিসরে। নতুন নতুন গল্প নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছেন। শিল্পীরা পরিচিতি পাচ্ছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। প্রশংসিত হচ্ছে তাঁদের কাজ। নানা ধরনের নিরীক্ষাধর্মী কাজের সুযোগ হচ্ছে শিল্পী-নির্মাতাদের। এটি খুবই ইতিবাচক দিক। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইমের মতো বাংলাদেশি কনটেন্ট নিয়েও গড়ে ওঠে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম ভালোই চলছে। তাদের কাজ নিয়ে হচ্ছে নানা আলোচনা। আমাদের দেশের কাজ সারাবিশ্বের মানুষের কাছে সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে। বিদেশি গণমাধ্যমে উঠে আসছে আমাদের খবর। ভাবতেই ভালো লাগে।



শঙ্খ দাশগুপ্ত
ওটিটি আসার আগেই টিভি নাটকে এক ধরনের বঁাঁকবদল চোখে পড়ছিল। নির্মাতা অনেকে নিরীক্ষাধর্মী কাজ করে যাচ্ছিলেন। তরুণরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন গল্পে বিষয়বৈচিত্র্য তুলে ধরার। কিন্তু টিভি বা সিনেমার কাজে এক ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে। বাজেট আর সেন্সরশিপের কারণে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ থাকে না। সেই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। বড় বাজেটের পাশাপাশি সেসব গল্প তুলে ধরার সুযোগ আছে, যা অন্য মাধ্যমে নেই। তাই যাঁরা আগে থেকেই ভিন্নধর্মী গল্প, নিরীক্ষাধর্মী নির্মাণ নিয়ে ভাবছিলেন, তাঁদের জন্য ওটিটি নতুন এক দুয়ার খুলে দিয়েছে, যার সুবাদে বিষয়বৈচিত্র্যে ভরপুর গল্প আর নান্দনিক নির্মাণে পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়া যাচ্ছে। তার চেয়ে বড় বিষয়, নিজেদের কাজ বিশ্বের নানা প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে অনায়াসে। দেশীয় ওয়েব সিরিজের উত্থানের কারণ এটাই।