- নন্দন
- অনলাইনে গানের ফিউশন
অনলাইনে গানের ফিউশন

সময়কে ছাপিয়ে কিছু গান হয়ে উঠেছে চিরকালের। সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে আজও তাই অনুরণন তুলে যাচ্ছে শ্রোতার মনে। সেসব গানের গীতিকথায় উঠে এসেছে আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ, সমাজ বাস্তবতার, দ্রোহ, আধ্যাত্মিকতা কিংবা চেনা জীবনের নানা অধ্যায়ের দৃশ্যপট। হৃদস্পন্দনের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে সুরের ছন্দ। অন্যদিকে সময়ের পালা বদলে সংগীতে এসেছে নতুনত্ব। প্রতি দশকেরই নতুনধারা গান জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তারপরও কিছু গানের আবেদন থেকে গেছে যুগের পর যুগ। যে কারণে সংগীতায়োজকরা কালজয়ী গানগুলো নতুন সংগীতায়োজনে আবার তুলে ধরছেন শ্রোতার কাছে। প্রকাশনার মাধ্যমে বদলে যাওয়ায় অনলাইন হয়ে উঠেছে সংগীতের বহুমাত্রিক আয়োজনের অন্যতম প্ল্যাটফর্ম। যেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে ফিউশনধর্মী পরিবেশনা। আলোচনায় এসেছে ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’, ‘আইপিডিসি আমাদের গান’, ‘সিলন মিউজিক লাউঞ্জ’, ‘কোক স্টুডিও বাংলা’, ‘ফোক স্টেশন’-এর মতো আয়োজনগুলো। যেখানে নন্দিত তারকাশিল্পীদের পাশাপাশি তরুণরাও নতুন সংগীতায়োজনে কালজয়ী গানের পরিবেশনা দিয়ে দর্শক-শ্রোতার মনোযোগ কেড়েছেন।
গত কয়েক বছরে আমরা নতুন সংগীতায়োজনে শোনার সুযোগ পেয়েছি ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর ‘জীবনানন্দ’, রথীন্দ্রনাথ রায়ের ‘আরেকবার আসিয়া’, এন্ড্রু কিশোরের ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, সুবীর নন্দীর ‘পাখি রে তুই’, ‘আমি বৃষ্টির কাছে’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা’, বারী সিদ্দিকীর ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, কুমার বিশ্বজিতের ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, অদিতি মহসিনের কণ্ঠে রবিঠাকুরের ‘তুমি কোন কাননের ফুল’, মাকসুদুল হকের কণ্ঠে ফিডব্যাকের ‘গীতিকবিতা-২ [চোখে জলে ভেজা], আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে এলআরবি’র ‘সেই তুমি’ [চলো বদলে যাই], জেমসের গাওয়া ফিলিংসের ‘তারায় তারায় রটিয়ে দেব’, কুদ্দুস বায়তীর কণ্ঠে ‘পাগলা ঘোড়া রে’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান।
অন্যদিকে একাধিক গানের ফিউশনের মধ্যে দিয়ে আলোচনায় ছিলেন তরুণ ও তারকাশিল্পী অনেকেই। শায়ান চৌধুরী অর্ণবের সংগীত প্রযোজনায় রেকর্ড কালজয়ী বিভিন্ন গানের সমন্বয়ে রেকর্ড করা ‘হেই সামালো’ [শিল্পী-সামিনা চৌধুরী, বাপ্পা মজুমদার, অর্ণব, কনা, সুনিধি নায়েক, ঋতুরাজ বৈদ্যসহ অর্ধশতাধিক শিল্পী ও মিউজিশিয়ান], ‘দখিনা হাওয়া’ [শিল্পী মধুবন্তি বাগচী, তাহসান], ‘নাসেক নাসেক’ [অনিমেষ রায় ও পান্থ কানাই], লীলাবতি [শিল্পী- ওয়ার্দা আশরাফ, আরমিন মুসা, নন্দিতা, মাশা প্রমুখ], ‘সব লোকে কয়’ [শিল্পী- কানিজ খন্দকার মিতু, মুসশিদাবাদী, জান্নাতুল ফেরদৌস, আকবর ও রুবাইয়াৎ রেহমান], ‘প্রার্থনা’ [শিল্পী- মমতাজ বেগম ও মিজান], ‘ভবের পাগল’ [শিল্পী- নিগার সুলতানা সুমি ও জালালি সেট], ‘চিলতে রোদে’সহ [শিল্পী- অর্ণব ও রিপন] আরও বেশ কিছু গান গত বছর দারুণ সাড়া ফেলেছে। এ ছাড়াও গত কয়েক বছর ফোক ফিউশন ছিল চোখে পড়ার মতো, যা সংগীতপ্রেমীদের মাঝে দারুণ সাড়া ফেলেছে। চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওনের ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’, ‘নিশা লাগিলো রে’, শফি মণ্ডলের ‘মন আমার দেহ ঘড়ি’, নাদিয়া ডোরার ‘আমার অন্তরায় আমার কলিজায়’, ‘প্রাণ সখিরে’, লায়লার ‘জাত গেল’, বিউটির ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর’, পলাশ ও অংকনের ‘বেতের আড়া’ গানগুলো ছিল অনেকের মুখে মুখে। এর বাইরেও ফজলুর রহমান বাবুর ‘দোল দোল দুলুনি’, জলের গানের ‘ইসকুল খুইলাছে রে মওলা’, ‘পরের জাগা পরের জামিন’, হৈমন্তির ‘চাঁন মুখে মধুর হাসি’, নবনীতা চৌধুরীর ‘বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না’সহ আরও বেশ কিছু গান শ্রোতার হৃদয় আন্দোলিত করেছে। ফোকের বাইরেও গত কয়েক দশকের কালজয়ী আধুনিক গানের পরিবেশনা দিয়েও প্রশংসা কুড়িয়েছেন বাপ্পা মজুমদার, মিফতা জামান, নিশিতা বড়ুয়া, লিজা, মাহাদী, সালমা, নন্দিতা, অপু, প্রিয়াঙ্কাসহ তরুণ আরও বেশ কিছু শিল্পী। এখন প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণেই কি একের পর এক ফিউশনধর্মী আয়োজন? এ প্রশ্নের উত্তরে শিল্পী ও সংগীত পরিচালক বাপ্পা মজুমদার বলেন, ‘কিছু সৃষ্টি চিরকাল থেকে যায়, যেমন আমাদের অগণিত লোকগান। আত্মপরিচয় যেমন ভুলে থাকা সম্ভব নয়, তেমনি গানের বিষয়েও ভুলে থাকা সম্ভব নয় ইতিহাস-ঐতিহ্যকে। আমাদের মাটির গান তাই থেকে যাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এই গানের মাহাত্ম্য তুলে ধরতেই মূলত নতুন সংগীতায়োজনে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরা হচ্ছে আমি মনে করি।’ শিল্পী পান্থ কানাইয়ের কথায়, বহু বছর পরেও যে সৃষ্টি সমকালীন মনে হয়, তা নানাভাবে উঠে আসাই স্বাভাবিক।
রিমেক কিংবা ফিউশন যেভাবেই হোক, বিভিন্ন দশকের অনবদ্য সৃষ্টি শ্রোতার কাছে পৌঁছাচ্ছে– এটাই বড় কথা। তাঁর এই কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন অনেকেই। ফাহমিদা নবী বলেন, ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’, ‘কোক স্টুডিও বাংলা’সহ আরও যেসব প্ল্যাটফর্মে শ্রোতারা আমাদের শিকড়ের গান, হারোনো দিনের গান কিংবা আমাদের পুরোনো গানগুলো নতুন করে শোনার সুযোগ পাচ্ছেন, তা একদিকে আমাদের অনবদ্য সৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, তেমনি সময়ের চাহিদাও পূরণ করছে। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, প্রতিটি আয়োজনে যে বৈচিত্র্য– তা বাংলা গানের নান্দনিকতাই তুলে ধরছে। তাই এমন আয়োজন আরও হওয়া উচিত বলেই মনে করি। নিশিতা বড়ুয়ার কথায়, তরুণ শিল্পীরাও প্রিয় শিল্পীর প্রিয় গানগুলো নিজ কণ্ঠে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের নানা ধরনের আয়োজনের সুবাদে। এতে তরুণ শিল্পীদের যেমন মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হচ্ছে, তেমনি নিজেদের পরিচিত নতুনভাবে তুলে ধরতে পাচ্ছেন দর্শক-শ্রোতার কাছে। বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী আবদুল হাদীও মনে করেন, হাতেগোনা কিছু আয়োজন দিয়ে সংগীত তৃষ্ণা মেটানো সম্ভব নয়। নতুন গান যেমন তৈরি হবে, তেমনি বিভিন্ন দশকের সেরা সৃষ্টিগুলো তুলে ধরতে হবে নতুন প্রজন্মের কাছে। যদি কথা, সুর অবিকৃত থাকে তাহলে রিমেক বা ফিউশন প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকবে না। তাই আয়োজন যেমনই হোক, সেখানে কালজয়ী গানগুলোর প্রকৃত আদল ধরে রাখতে হবে। আশার কথা হলো, সে চেষ্টাও করে যাচ্ছেন অনেকে।
মন্তব্য করুন