‘বল তো, মাহা কি পারবে ডেভিডের আসল পরিচয় বের করতে’– পথচলতি এক তরুণ তার সহযাত্রীকে এই প্রশ্ন করছে দেখে অবাক হয়নি। কারণ এর আগেও চোখে পড়েছে, একজন আরেকজনের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করছে এই বলে– ‘বুঝলাম না, তাকদীরের ফ্রিজার ভ্যানে লাশ এলো কোত্থেকে!’ এমন মন্তব্যও শুনেছি, ‘ষ’ সিরিজের গল্প, ভৌতিক সিনেমাকেও হার মানিয়েছে। চলমান বাস্তবতা তুলে ধরেছে– এমন গল্প নিয়ে মুখর থাকতে দেখা গেছে অনেককে। ঘরোয়া আড্ডা থেকে শুরু নানা জায়গায় অনেকেরই মুখে উঠে এসেছে আমাদের ওয়েব সিরিজ ও ওয়েব ছবি নিয়ে নানা প্রশ্ন, প্রশংসা আর কৌতূহল, যা থেকে  অনুমান করা যায়, বিনোদন মাধ্যম হিসেবে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর আয়োজন কতটা সাড়া ফেলছে।

অবাক করা বিষয় হলো, শুধু দেশীয় দর্শক নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন দেশের দর্শকের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে ওটিটির সিরিজগুলো। অন্যদিকে অভিনয়শিল্পীরা বারবার নিজেকে ভেঙে নতুনরূপে পর্দায় তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যে কারণে সিনেমা ও টিভি নাটকের চেয়ে এখন বেশি আলোচনা শোনা যাচ্ছে ওটিটির আয়োজন নিয়ে। তার চেয়ে বড় বিষয়, ভালো কাজের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছে প্রতিটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। ‘মহানগর’, ‘কারাগার’, ‘তাকদীর’, ‘ষ’, ‘সাবরিনা’, ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’, ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’, ‘বোধ’, ‘দুই দিনের দুনিয়া’, ‘কাইজার’, ‘মরীচিকা’, ‘কন্ট্রাক্ট’, ‘জাগো বাহে’, ‘শাটিকাপ’, ‘বলি’, ‘গুটি’সহ আরও বেশ কিছু ওয়েব সিরিজ ও ছবি দর্শক প্রশংসা কুড়িয়েছে। নানা ধরনের গল্প নিয়ে নির্মিত সিরিজের মাধ্যমে নাটক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিল্পীরাও পা রাখছেন ওয়েব দুনিয়ায়, যার সুবাদে আরও বর্ণিল হয়ে উঠছে দেশীয় ওয়েব সিরিজগুলো।


অন্যদিকে বাঁকবদল চোখে পড়ছে আমাদের সিনেমাতেও। সম্প্রতি ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, ‘দামাল’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘মিশন এক্সট্রিম’ থেকে শুরু করে আরও বেশ কিছু ছবির মাধ্যমে দিন বদলের আভাস দিয়েছেন সিনেমা জগতের মানুষেরা। অথচ কয়েক বছর আগেও আমাদের সিনেমা নিয়ে অনেকের নেতিবাচক মন্তব্য ছিল– ‘দেশীয় চলচ্চিত্রে মৌলিকতার অভাব’, ‘অশ্লীলতা আমাদের চলচ্চিত্র গ্রাস করছে’, ‘নকলের দ্বৈরথ থেমে নেই’, ‘দেশি সিনেমা মানেই একই গল্পের পুনরাবৃত্তি’, ‘বেশিরভাগ ছবিই মানহীন’ ইত্যাদি। তবে আশার কথা হলো, সময়ের পালাবদলে এখন আমরা শুনতে পাচ্ছি আমাদের সিনেমার বাঁকবদলের কথা। নতুনরা সম্ভাবনার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন, স্বল্প বাজেটেও ভালো ছবি হচ্ছে। সিনেমা হল সংকটের মাঝেও চ্যালেঞ্জ নিয়ে সবাই কাজ করছেন– এই কথাও শোনা যাচ্ছে অনেকের মুখে। কিন্তু এত কিছুর পরও যেসব শিল্পী দর্শক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, তাঁদের অনেকেই ওটিটিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। সিনেমায় কেউ কেউ কাজ করছেন, কিন্তু তা সংখ্যায় খুবই কম। এমনকি ছোট পর্দার যে শিল্পীদের দর্শক বড় পর্দায় দেখতে চান, তাঁরাও ওটিটির দিকেই ঝুঁকে পড়েছেন। বড় পর্দায় নিয়মিত কাজ করার ইচ্ছা কারও মধ্যেই সেভাবে দেখা যায়নি। তেমনই কয়েকজন তারকার কাছে প্রশ্ন ছিল– ওটিটিতে কাজ করলেও সিনেমার বিষয়ে তাঁরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না কেন? এর উত্তরে ছোট পর্দার নন্দিত অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীর সোজাসাপ্টা কথা, ‘সিনেমায় অভিনয় করতেই হবে– এমন কোনো কথা নেই। অভিনয় এখন আমার জীবনের একটা অংশ। তাই ভালো কাজের জন্য যে কোনো মাধ্যম বেছে নিতে পারি। সেটা সিনেমাও হতে পারে। কিন্তু সিনেমায় অভিনয়ের লক্ষ্য নিয়ে অভিনয় করে যেতে চাই না।’ মেহজাবীনের মতো ভালো কাজের জন্য যে কোনো মাধ্যমে নিবেদিত থাকবেন বলে জানান অভিনেতা আফরান নিশো। তবে সিনেমায় নিয়মিত হওয়ার বিষয়ে তিনিও নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। সম্প্রতি ‘সুড়ঙ্গ’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে পা রেখেছেন তিনি। শুনিয়েছেন আশার কথাও। বলেছেন, ‘চলচ্চিত্রে এখনকার যে ধারা, সেটা চলমান থাকলে সিনেমায় নিয়মিত হবো।’ এ-ও স্বীকার করেছেন, আমাদের চলচ্চিত্রের বাঁকবদল হচ্ছে; বদলে যাচ্ছে গল্পের ধরন ও তার উপস্থাপনা, তরুণদের অনেকে বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিনেমা নির্মাণের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে– এটা দেখেই বড় পর্দায় অভিনয়ে এসেছেন। কিন্তু এই মাধ্যমে স্থায়ী হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করবে আগামী সময়।

অভিনেতা অপূর্ব ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’ ও ‘যদি কিন্তু তবুও’ ছবিতে অভিনয়ের পরও নাটক, টেলিছবি ও ওয়েব সিরিজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন সব সময়। তাঁর কথায়, সিনেমায় নিয়মিত হওয়া তখনই সম্ভব, যখন ধারাবাহিকভাবে ভালো কাজের সুযোগ পাওয়া যাবে। ‘বেঙ্গলি বিউটি’ ছবির পর একই কথা শোনা গেছে অভিনেত্রী মুমতাহিনা টয়ার মুখে। অন্যদিকে তানজিন তিশা অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার কাছে এখনও সিনেমার এমন কোনো গল্প আসেনি, যে গল্প শুনলেই মনে হবে এটাই হতে পারে আমার ছবি। যেদিন তেমন কাজের প্রস্তাব আসবে, সেদিন ঠিকই সিনেমাতে দেখা যাবে।’ অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিণও স্বীকার করেছেন কলকাতার ‘আরও এক পৃথিবী’ ছবিতে অভিনয়ের আগে এমন কোনো গল্পে কাজ করার প্রস্তাব পাননি, যা তাঁকে সিনেমা জগতে টেনে নিতে পারে। তাই সিনেমার বিষয়ে আগ্রহ ছিল না। অন্যদিকে সাবিলা নূর ‘মুজিব’ ছবিতে অভিনয়ের পর নিজেকে সিনেমার পরিণত অভিনেত্রী মনে করেন না। তাঁর কথায়, সিনেমায় অভিনয়ের জন্য এখনও অনেক কিছু শেখার বাকি আছে তাঁর।

অন্যদিকে ওটিটির আলোচিত তারকা নাজিয়া হক অর্ষা বলেন, ‘সিনেমা নিয়ে স্বপ্ন আছে। কিন্তু আমি যেমন গল্প ও চরিত্র চাই, তা না পেলে অভিনয় করব না। এখন ওটিটিকে প্রাধান্য দিচ্ছি। আমি মনে করি, আগামীতে ওটিটি প্ল্যাটফর্মই টিকে থাকবে।’ তাঁদের এমন মতামতের পরও সিনেমা জগতের মানুষেরা আশাবাদী। অভিনয়শিল্পী রিয়াজ, মৌসুমী, মিশা সওদাগরসহ অনেকের মতে, ভালো কাজই অন্যান্য মাধ্যমের শিল্পীদের চলচ্চিত্র জগতে টেনে আনবে। তাই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে ভালো কাজের ধারাবাহিকতা। এ নিয়ে তাঁরা এখন আশাবাদী এ কারণেই যে, দেশীয় সিনেমার রূপরেখা বদলাতে শুরু করেছে। দর্শকও হলমুখী হচ্ছেন।