- নন্দন
- টিভিতে ঈদ: সমঝোতা
টিভিতে ঈদ: সমঝোতা

ঈদ আয়োজনে টিভি চ্যানেলগুলো নানা ধরনের আয়োজন করে থাকে। যেখানে নাটক, টেলিছবি প্রাধান্য পেয়েছে সব সময়। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না বলে জানিয়েছে টিভি চ্যানেলগুলো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন আয়োজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তা কতটা তারকাবহুল হবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এ নিয়ে চ্যানেল কর্মকর্তারা থেকে শুরু করে অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা ও প্রযোজকরা তী ভাবছেন– তা নিয়ে এ আয়োজন। লিখেছেন রাসেল আজাদ বিদ্যুৎ
এখনও দর্শক বিনোদনের প্রধান মাধ্যম টেলিভিশন। সমীক্ষা চালিয়ে সেই প্রমাণই পাওয়া যায়। যদিও অনেকের দাবি, অনলাইনের কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে টিভি চ্যানেলগুলো। কারণ অনলাইন দুনিয়ায় হরেক রকম আয়োজন হচ্ছে। ইউটিউব কনটেন্টের পাশাপাশি ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর ওয়েব সিরিজ ও ছবিগুলো ক্রমাগত কেড়ে নিচ্ছে দর্শক মনোযোগ। তাই আসছে ঈদে অনলাইনের পাশাপাশি টিভি আয়োজনগুলো কেমন হবে, তা জানার কৌতূহল অনেকের। ওটিটি আয়োজনে তেমন কোনো বিধিনিষেধ মানতে হচ্ছে না, কাজও হচ্ছে বড় বাজেটে। যে কারণে কাহিনিকার, নির্মাতা থেকে শুরু করে তারকা অনেকেই এই মাধ্যমকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।
অন্যদিকে বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইউটিউব চ্যানেলের জন্য নির্মাণ করে যাচ্ছে নাটক ও টেলিছবি। এ ছাড়াও ঈদের তালিকায় থাকছে গান, কৌতুকসহ নানা ধরনের আয়োজন। তাই ঈদের টিভি আয়োজন কতটা তারকাবহুল হবে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে টিভি চ্যানেলগুলো আগের জৌলুস ধরে রাখতে পারবে কিনা– সে প্রশ্ন থেকেই যায়। অন্যদিকে তারকারা কাজের বিষয়ে কে কী ভাবছেন, সেটাও একটা প্রশ্ন। এ নিয়ে শুরুতেই কথা হয় টিভি চ্যানেল কর্মকর্তাদের সঙ্গে।
এনটিভির অনুষ্ঠান প্রধান আলফ্রেড খোকন বলেন, ‘সুস্থ-সভ্য-সুন্দর এমন অনুষ্ঠান নির্মাণ ও প্রচারের পক্ষে এনটিভি। যে জন্য অনুষ্ঠানের মান ধরে রাখতে পারছি কিনা, সেটাই আমাদের ভাবনায় থাকে। অনুষ্ঠান তারকাবহুল হয়ে উঠেছে কিনা– এ ভাবনা কখনও কাজ করে না। মৌসুমি তারকা; যাঁরা আজ জনপ্রিয়, কাল সেই জনপ্রিয়তা থাকবে কিনা– এমন প্রশ্ন যাঁদের নিয়ে, তাঁদের গুরুত্ব দেওয়া কতটা ঠিক? মানছি, এমন অনেক দর্শক আছেন, যাঁদের নজর এসব মৌসুমি তারকার দিকে থাকে।
কিন্তু আমরা মনে করি, শৈল্পিক কাজের জন্য শিল্পী প্রয়োজন, তারকা নয়। এ কারণেই এই ঈদে আমরা যে ২৮টি নাটক নির্বাচন করেছি, সেখানে ভালো গল্প, চরিত্র বিন্যাসে মুনশিয়ানা তুলে ধরতে পেরেছে কিনা, নির্মাণে আধুনিকতার ছাপ কতটা আছে– সেগুলো যাচাই-বাছাই করেছি। এর বাইরে ম্যাগাজিন, নৃত্যানুষ্ঠান, সংগীতানুষ্ঠান থেকে শুরু করে অন্যান্য আয়োজনেও এনটিভির নিজস্বতায় ছাপ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই তারকা বিষয়টি আমাদের কাছে মুখ্য নয়। আর অনলাইনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার যে প্রশ্ন, তা নিয়ে যে বিষয়টা আগে বলা উচিত, তা হলো– টেলিভিশন ফ্রি মিডিয়া। অন্যদিকে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যা দেখছেন, তার বিনিময়ে অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। টেলিভিশন আয়োজনে কিছু নীতিমালা মেনে চলতে হয়। অন্য মাধ্যমগুলোতে এর বাধ্যবাধকতা নেই। তাই দর্শকের দৃষ্টিতেও দুই মাধ্যমে পার্থক্য স্পষ্ট।’
আলফ্রেড খোকনের এ কথা থেকে জানা গেল, টিভি আয়োজনে তাদের ভাবনার কথা। এখন প্রশ্ন হলো, টিভি চ্যানেলগুলো কেন এখন তাদের আয়োজনগুলো অনলাইনে তুলে ধরার চেষ্টা করছে? এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটি করা হচ্ছে মূলত বাজে সমস্যার কারণে। বিজ্ঞাপনী বাজেটের ওপর নির্ভর করে টিভি আনুষ্ঠান নির্মাণ করা হয়। ২০০৫ সালে বিজ্ঞাপনের রেট যা ছিল, এখনও তা খুব একটা বাড়েনি। অন্যদিকে নাটক বা যে কোনো অনুষ্ঠানের কথাই বলুন, সেখানে শিল্পী সম্মানী থেকে শুরু করে নেপথ্যকর্মী সবার পারিশ্রমিক বেড়েছে। যে কারণে অনুষ্ঠানের ব্যয় বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া টাকা থেকে তুলে আনা কঠিন। ইউটিউব কনটেন্ট হিসেবে অনুষ্ঠানগুলো অনলাইনে তুলে ধরার সুবাদে সেই ব্যয় কিছুটা আয়ত্তের মধ্যে এসেছে। অনলাইন দ্বারস্থ হওয়ার কারণ মূলত এটাই।’
তাঁর এ কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান তারেক আখন্দ বলেন, ইউটিউবকে আমরা মূলত চ্যানেলের অংশ হিসেবেই ব্যবহার করছি। যেখানে চ্যানেলের আলোচিত নাটক, টেলিছবির পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অংশবিশেষ ছোট ছোট কনটেন্ট হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। যেগুলোর জনপ্রিয়তা পাওয়া, দর্শক আলোচনায় আসা টিভি আয়োজনের সাফল্যগাথা তুলে ধরা। ওটিটিকে আমি টেলিভিশনের সহযোগী মাধ্যম বলেই মনে করি। অনেকে বলেন, এখন ওয়েব সিরিজের জোয়ার চলছে। কিন্তু টিভি নাটক থেকে ওয়েব সিরিজের দর্শক কতটা বেশি? এ প্রশ্নের উত্তর সঠিক সমীক্ষা ছাড়া পাওয়া যাবে না। টিভি অনুষ্ঠান বিশেষ করে ফিকশনের জনপ্রিয়তা আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। তাই এবার ঈদেও বাংলাভিশন ফিকশনকেই প্রাধান্য দিয়েছে।
টিভির ঈদ আয়োজনে তারকা সংকটের আশঙ্কা আছে কিনা, তা জানতে চাইলে প্রযোজক ও বাংলাদেশে টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজু মুনতাসির বলেন, ‘ওটিটির কারণে টেলিভিশনে তারকা সংকট দেখা দিয়েছে বা দেখা দিতে পারে, আমার তা মনে হয় না। আসছে ঈদের জন্য মাছরাঙা টিভি, চ্যানেল আইসহ আর কিছু চ্যানেলের জন্য বেশকিছু নাটক নির্মাণ করেছি। সেখানে অভিনয় করেছেন তাসনিয়া ফারিণ থেকে শুরু করে সাবিলা নূর, সামিরা খান মাহি, কেয়া পায়েলের মতো জনপ্রিয় তারকারা। পাশাপাশি মাবরুর রশীদ বান্না, মিজানুর রহমান আরিয়ান, মাহমুদুর রহমান হিমি, অনন্য ইমনের মতো আলোচিত নির্মাতাদের পেয়েছি টিভি আয়োজনের জন্য। তবে এটি সত্যি, কেউ কেউ সম্মানী বাড়িয়ে দেওয়ায় তাঁদের সঙ্গে কাজ করা হয়ে উঠছে না। দু-একজন আবার ওটিটির জন্য টিভিতে অভিনয় করার আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কিন্তু এর জন্য টেলিভিশনে শিল্পী সংকট তৈরি হবে, তা মানতে পারছি না।’ একই রকম কথা শোনা গেছে, প্রযোজক শাহরিয়ার শাকিলের মুখেও। একই সঙ্গে তিনি স্বীকার করেছেন, ওটিটির জয়জয়কার শোনা গেলেও টেলিভিশন আয়োজনের আবেদন থাকবেই।
অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর কাছে ভালো এবং ব্যতিক্রমী কাজই মুখ্য, মাধ্যম নয়। তিনি বলেন, ‘বড় পর্দা, ছোট পর্দা, টিভি বা অনলাইন– যেখানেই কাজ করি, সেটা দর্শকমনে ছাপ ফেলবে কিনা– এটাই ভাবনায় থাকে। কোনো মাধ্যমের সঙ্গে কোনো মাধ্যমের তুলনা অবান্তর। তাই কাজ ভালো হলে টিভিতে আগে যেভাবে কাজ করে গেছি, সেভাবেই করে যাবো।’ অভিনেতা আফরান নিশো বলেন, ‘ওটিটিতে ভালো কাজ হচ্ছে। তাই এ মাধ্যমে অনেকেই ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু সেই কারণে টেলিভিশনের প্রতি সবার আগ্রহ হারিয়ে গেছে, এটি ভাবা ঠিক হবে না। আর শিল্পী বা তারকাদের কথা যদি বলেন, একটা বিষয় সামনে এসে দাঁড়ায় তাঁর সিদ্ধান্ত। সৃষ্টিশীল কাজে শুরুতেই এক ধরনের সমঝোতায় যেতে হয়, সেটা হলো জনপ্রিয়তার দৌড়ে অংশ নেবেন, নাকি শিল্পীসত্তাকে খুশি করতে কাজ করে যাবেন। কাজের মাধ্যম নির্বাচনে এক ধরনের সমঝোতায় যেতে হবে। পারিশ্রমিক বেশি পাওয়ার জন্য ওটিটিকে প্রাধান্য দেবেন, নাকি গল্প, চরিত্র, ভালো নির্মাতা পেলে কম বাজেটের টিভি নাটকেও অভিনয় করবেন। তবে আমার মনে হয়, টেলিভিশনের হাত ধরে যাঁদের পরিচিতি, জনপ্রিয়তা তাঁরা এই মাধ্যম থেকে সহজেই দূরে সরে যাবেন না। এই ঈদে তার প্রমাণ মিলবে।’
অভিনেতা মোশাররফ করিমের কথায়, ওটিটিতে সময় নিয়ে কাজ করা যায়। তাড়াহুড়া থাকে না। কিন্তু টিভি নাটকে ঘড়ি ধরে কাজ করতে হয়। বড় বাজেট, সময় নিয়ে কাজ করার সুযোগ– এ রকম বেশ কিছু সুবিধা আছে ওটিটির কাজে। যদিও শুরুতে অনেকেই এই মাধ্যমে কাজ করতে চাননি। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে তারকার সংখ্যা বাড়ছে। কাজ করে সাড়াও পাচ্ছেন কমবেশি সবাই। তবে এর কারণে টিভি আয়োজনে তারকা সংকট দেখা দিতে পারে বলে মনে হয় না। নিজেও ওয়েব সিরিজ ও টিভি নাটকে বেশি সময় দিই। বিশেষ করে ঈদের সময়। অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মমর কথায়, টিভি ধারাবাহিকে আগ্রহ না থাকলেও একক নাটক, টেলিছবি নিয়ে অনীহা নেই। আসছে ঈদেও টিভি নাটকে দেখা যাবে তাঁকে। এদিকে অপূর্ব, তানজিন তিশা, সাফা কবির, তৌসিফ মাহবুব, জোভান, শহীদুজ্জামান সেলিম, ফজলুর রহমান বাবুসহ ওটিটিমুখী হওয়া আরও কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী ঈদের টিভি নাটকের কাজে ব্যস্ত বলেও জানিয়েছেন।
বরেণ্য অভিনেতা ও নির্দেশক মামুনুর রশীদ বলেন, ‘টিভি নাটকে বাজেট স্বল্পতা থাকলেও ওয়েবে সেই সমস্যা নেই। যে জন্য কিছুটা ভালো মানের কাজ উপহার পাচ্ছেন দর্শক। তবে টিভিতেও ভালো কাজের সংখ্যা বেড়ে যায় ঈদ এলে। এ সময় তুলনামূলকভাবে বাজেট কিছুটা বাড়ে। কাজও ভালো হয়। তাই ঈদে টিভি আয়োজন নিরাশাজনক হবে বলে মনে করি না।’ পরিচালক সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘ওয়েব সিরিজ’ আর টিভি নাটকের মধ্য পার্থক্যটা কোথায়, দর্শকের কাছে এখন তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাই ঈদের নাটক সম্পর্কেও তাদের যে প্রত্যাশা, যেখানে খুব একটা রতবদল হবে বলে মনে হয় না। নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ সবাই জানেন, ঈদ আয়োজন নিয়ে দর্শকের চাওয়া কী। তাই কোন মাধ্যমে কোন ধরনের কাজে সাড়া ফেলেছে, সেটা ভাবনার বিষয় হতে পারে না। ভালো কিছু করার ইচ্ছা যখন প্রবল, তখন অনেক মোহ কাটাতে হয়। এটাই আসছে সৃষ্টিশীল কাজের বিষয়ে নিজের সঙ্গে সমঝোতা। এই সমঝোতা শিল্পী, নির্মাতা, প্রযোজক, পরিবেশক সবার থাকতে হবে।’
মন্তব্য করুন