- নন্দন
- ‘আজম খান অমরত্ব লাভ করেছে তার কালজয়ী গানের মধ্য দিয়ে’
‘আজম খান অমরত্ব লাভ করেছে তার কালজয়ী গানের মধ্য দিয়ে’

বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তি, বীর মুক্তিযোদ্ধা আজম খানের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (৫ জুন)। ২০১১ সালের এই দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই ‘পপগুরু’। প্রতি বছর এই দিনে আজম খানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তার পরিবার, বন্ধু-স্বজন, শুভাকাঙক্ষী ভক্ত-শিষ্যরা। বিশেষ এই দিনটিতে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন আরেক জনপ্রিয় গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদ।
১৯৭৩ সালের কথা। তখন ইশতিয়াক, ল্যারি, ইদুসহ বেশ কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে একটি গানের দল করেছিলাম। আমরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তখন শুধু ইংরেজি গান করতাম। তারপরও বাংলা গান গাওয়ার একটা তাগিদ ছিল। সেটা জেনেই আমাদের আরেক বন্ধু শিল্পী ফিরোজ সাঁই এক দিন এসে আমাকে জানায়, তার পরিচিত একটি ছেলে আছে, নাম আজম খান। ভালো গায়। তাকে নিয়ে বাংলা গান করা যেতে পারে। কিন্তু দলের অন্যরা বাংলা গান গাওয়ার পক্ষে ছিল না। তার পরও আমি ফিরোজ সাঁইকে বলি, আজম খানের সঙ্গে দেখা করার কথা। এরপর ফিরোজ সাঁইয়ের মাধ্যমে পরিচয় হয় আজম খানের সঙ্গে। পরিচয়ের প্রথম দিনেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে যায়। তার গায়কীও আমাকে মুগ্ধ করে। তাই গান রেকর্ড করারও পরিকল্পনা শুরু করি।
বন্ধু শামীম ও রুমির সঙ্গে আড়াইশ টাকা দিয়ে ইন্দিরা রোডের ঢাকা রেকর্ডিং স্টুডিওতে শিফট ভাড়া করি। এরপর আজম খান ও আমি দু'জনে মিলে রেকর্ড করি চারটি গান। আজম খানের তুমুল জনপ্রিয় দুই গান 'ওরে সালেকা ওরে মালেকা' ও 'হাইকোর্টের মাজারে' সেদিন রেকর্ড করা হয়েছিল। আমি রেকর্ড করেছিলাম 'চাঁদ জাগে তারা জাগে' ও 'দুনিয়াটা কত মজার' গান দুটি। এই গানগুলো শোনার পর স্টুডিওর মালিকের এতটাই ভালো লেগেছিল যে, তিনি আমাদের গান রেকর্ড আকারে প্রকাশ করারও দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সেই গানগুলো সুপারভিশন করে দিলেন আজম খানের বড় ভাই খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক আলম খান। স্টুডিওর মালিক তাঁর কথা রাখতেও খুব একটা দেরি করেননি। প্রথম আজম খানের দুটি গান রেকর্ড আকারে প্রকাশ করা হয়। প্রকাশের পরপরই গান দুটি দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে। জনপ্রিয়তার সেই রেশ ধরেই একসময় আমরা গড়ে তুলি বাংলা পপ গানের ব্যান্ড 'উচ্চারণ'।
এরপর উচ্চারণের সঙ্গে শুরু হয় নতুন করে পথচলা। যে পথ পাড়ি দিতে গিয়েই আজম খান হয়ে উঠেছে তার কালের অনন্য এক শিল্পী। ব্যান্ডের জগতে পেয়েছে গুরুখ্যাতি। তার কালকে জয় করে জায়গা করে নিয়েছে কিংবদন্তিদের কাতারে। তাই আজম খান চলে গেলেও অমরত্ব লাভ করেছে তার কালজয়ী গানের মধ্য দিয়ে।
আজম খান সেই শিল্পী, যাকে প্রথম শ্রোতারা গুরু বলে সম্বোধন করা শুরু করেছিল। আজম খান আমাদের দেশসেরা রকস্টার- এমন কথাও লোক মুখে অনেক শুনেছি। অথচ এই আজম খান নিজেও হয়তো জানত না সে কত বড় মাপের শিল্পী। নইলে যে মানুষটিকে নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়, সে অহমবর্জিত জীবন কাটাতে পারত না। বড় মাপের মানুষ হয়তো এমনই। তারা জনপ্রিয়তাকে উপভোগ করে, তা নিয়ে অহঙ্কার করে না। আজম খান কতটা সাদা মনের মানুষ ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। সবার মাঝে সহজেই মিশে যেতে পারত, অনায়াসে আপন করে নিতে পারত সবাইকে- এমন গুণ ক'জনের আছে সেটাই ভাবার বিষয়। ভাবতে ভালো লাগে, এমন একজন মানুষ ছিল আমার পরম বন্ধু। আবার কষ্ট লাগে এটা ভেবে যে, আজম খানের মতো উদারমনা বন্ধুটি আজ আমাদের মাঝে নেই। সে চলে গেছে না ফেরার দেশে, রেখে গেছে অজস্র স্মৃতি।
বন্ধু আর শিল্পী আজম খানের মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যখন সে বন্ধু হিসেবে কাছে থাকত, তখন ভুলে যেত শিল্পী আজম খানের পরিচয়। গল্প-হাসি-আড্ডায় আসর জমিয়ে রাখত। মাঝেমধ্যে ছেলেমানুষিও ভর করত ওর মধ্যে। একটা ঘটনা বলি। এক শোতে আমরা কয়েকজন শিল্পী অংশ নিয়েছি। দর্শক আজম খান, আজম খান বলে আওয়াজ তুলছে। এটা দেখে আমি ওকে বললাম মঞ্চে উঠে যেতে। ও হেসে বলল, 'তোরা আগে গান শোনাতে থাক। আমি ততক্ষণ ঘুমিয়ে আসি। ঘুম ভাঙলে তারপর গান শোনাব।' এই হলো আজম খান। পরিস্থিতি যেমনই হোক- সবকিছু সহজভাবে নিতে পারত। অনেকে যখন তারকাখ্যাতির অহমে অন্ধ, তখনও সে আট-দশটা মানুষ থেকে নিজেকে আলাদা ভাবত না। সে যে কত বড় মাপের তারকা, কেন তাকে গুরু বলে লোকে, কিংবদন্তি শিল্পী হিসেবে পরিচয় করায়- সেসব নিয়ে আদৌ কোনোদিন ভেবেছে কিনা জানি না। এতটাই সাদাসিধে মানুষ ছিল আজম খান। এই সাদাসিধে মানুষটাই আজ অমর হয়ে আছে তার কালজয়ী গানের মধ্য দিয়ে। যুগের পর যুগ তার গান মানুষের মনে দাগ কেটে যাবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। একজন শিল্পী জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারে না।
মন্তব্য করুন