ঢাকা থিয়েটারের প্রাচ্য
প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক

দৃশ্য : প্রাচ্য ছবি :: ফয়সাল সিদ্দিক কাব্য
মুনিরা মাহজাবিন মিমো
প্রকাশ: ০২ আগu ২০২৩ | ১৮:০০
১৩ শ্রাবণের এক অপূর্ব শুভ্র সন্ধ্যায় সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মধ্য দিয়ে ঢাকা থিয়েটার মঞ্চায়ন করল সেলিম আল দীনের ‘প্রাচ্য’। বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় যে নাট্যদলের কথা মুখে মুখে ফিরে আসে, তাদের প্রযোজিত একটি নাটকের দুই দশক পর পুনঃমঞ্চায়নের সাক্ষী হতে পারাও আনন্দের। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিবৃত্ত পাঠে যেসব গুণীজনের নাম এবং নাট্যদলগুলোর কথা সবার আগে জানতে হয়, ঢাকা থিয়েটার ও তার সঙ্গে জড়িত নাট্যজনরা অন্যতম। তাই সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে অংশগ্রহণ করাও ইতিহাসের একটা অধ্যায়কে ভীষণ কাছে থেকে দেখার মতো। ‘প্রাচ্য’র গল্প কাঠামো সুন্দর ও সুষম। নাট্য রচনায় অনবদ্য সেলিম আল দীন প্রাণ-প্রকৃতি এবং মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক অপূর্বরূপে তাঁর শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সয়ফর চান কোনো এক ভাসান যাত্রার আসরে দেখেছিল নোলক নামে এক তরুণীকে। শিগগির সেই তরুণীর সঙ্গে পরিণয়ে আবদ্ধ হয় সয়ফর। নোলক-সয়ফরের বিয়ের বরযাত্রীর ফিরতি পথের বর্ণনাতে নাটকের একটি দীর্ঘ পথ আঁকতে আঁকতে সেলিম আল দীন অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের ঘটনাবহুল বিস্তীর্ণ জনপদের মানুষ ও তাঁর চারপাশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের সেতু গড়ে তোলেন। সয়ফরের স্মৃতির সঙ্গে প্রকৃতি আর মানুষের নিবিড় সম্পর্ক গল্পের আড়মোড়া ভেঙে দর্শককুলকে সজাগ রাখে। সয়ফর চানের নববধূকে বাসর রাতে সাপে কাটে। যেন মনসা পুরাণেরই এক সমান্তরাল গল্প। একুশ শতকের শুরুতে নাটকটি প্রথম দর্শক প্রদর্শনী হয়েছিল। কিন্তু গল্পের ভ্রমণ এমন, যেন দর্শক সমকাল পিছে ফেলে এক মহাকালের পুরাণ-যাত্রী হয়ে ওঠে। নববধূকে বাঁচানোর জন্য সয়ফরের প্রাণপণ চেষ্টা, উন্মত্ত প্রতিশোধ স্পৃহা, সাপের প্রতি জন্ম নেওয়া ক্ষোভ নাট্যকারের সুনিপুণ সৃজনশৈলীর কারণে দর্শককে সয়ফরের আসনে বসিয়ে দেয়। মিলনায়তনের অভ্যন্তরের দর্শক হয়ে ওঠে শাকুকভাঙা গ্রামের পেশিবহুল দিনমজুর সয়ফর। সয়ফরের দেহের চলন, অভিনব অভিনয় আয়তনের বহুমাত্রিক ব্যবহার আমাদের অস্থির করে তোলে। নির্দেশকের সৃজনী ভাবনার একনিষ্ঠ ও দেশজ-অনুসন্ধানী প্রয়োগ দর্শকের অসীম আগ্রহের দরজা-জানালা খুলে দিয়ে পুবাল বাতাস ধেয়ে এসে নিয়ে যায় বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজে। ততক্ষণে আমরা ঘটনার সহযাত্রী, আর দর্শক নই যেন! প্রতিশোধ-স্পৃহাগ্রস্ত সয়ফরের যাত্রা পথে, নাট্যগল্পের অন্তিম পর্বে, হত্যাকারী সাপকে খুঁজতে অস্থির উন্মাদ নির্ঘুম অবিশ্রান্ত যখন সয়ফর, তখন কী এক অতলান্ত আহ্বানে নোলকের হত্যাকারী সাপকে মুখোমুখি পেয়েও সে ক্ষমা করে দেয়। সাপটিকে হত্যা না করা কি শুধুই ক্ষমা নাকি অন্য কিছু? এমন একটি প্রশ্নও ছুড়ে দেন নাট্যকার। সয়ফর চান ঘরের ভেতর ইঁদুরের গর্ত দেখে বলতে থাকে নিজেকেই নিজে, ‘গর্ত থাকলে সাপ আছে। সাপ থাকলে ইঁদুর থাকে। ইঁদুর থাকে ধানের পিছে। ধান থাকলে ক্ষেত থাকে। ক্ষেত থাকলে ভিটা। ভিটার ওপর আকাশও ফণা।’ সাপটি নোলকের কবরের ওপর দিয়ে নীরবে ভূমি-মুখো হয়ে চলে যায়। সেলিম আল দীন নাটকের এই শেষ দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘সৌন্দর্য ভয় ও রহস্য সবার মনে সম্ভ্রম জাগায়। হত্যা ভুলে যায় তারা।’ প্রাচ্য নাটকে সেলিম আল দীন যেন আমাদেরই এক মানবিক দিক তুলে ধরেছেন, হত্যাকারী সেই সাপকেও তাই সয়ফর যেন ক্ষমা করে দেয় দিনশেষে। প্রকৃতির সঙ্গে বাংলার সাধারণ মানুষের যে নিবিড় সম্পর্ক ও নির্ভরতা তা যেন পাশ্চাত্যের থেকে প্রাচ্যকে অতুল্য করে, অনন্য করে। ‘প্রাচ্য’ যেন তারই সুদৃঢ় এবং সুস্পষ্ট দৃশ্যকাব্য। ‘প্রাচ্য’ নামকরণের সার্থকতা বুঝি এখানেই। ‘প্রাচ্য’ বাংলার চিরায়ত পাঁচালি রীতি প্রেরণাজাত ও সেলিম আল দীন সৃজিত নাটক। প্রাচ্যের চোখেই প্রাচ্যকে অনুসন্ধানের একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা এই নাটকের মাঝে যেন লুকায়িত। বাংলার চিরায়ত সৌন্দর্য যেমন চিত্রায়িত হয়েছে, এ নাটকে আবার একই সঙ্গে দৃশ্যের ভাঁজে ভাঁজে এসেছে সামন্তবাদের গল্প। বাংলার জনজীবনের বিশ্বাস এবং বিশ্বাস ঘিরে উৎসবের বর্ণনাও এসেছে পদের মাধ্যমে। ‘প্রাচ্য’ সম্পর্কে একটি গভীর আগ্রহের জন্ম হয়েছিল তামিমা সুলতানার ‘প্রাচ্য ও দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ শীর্ষক চিত্র প্রদর্শনী দেখার পর। এবার নাটক দেখে সত্যি অভিভূত। চিত্র প্রদর্শনী ও নাট্য প্রদর্শনীর বুনন যে গল্পের সুতোয় বাঁধা তার রূপকার যে সেলিম আল দীন! অদ্ভুত সুন্দর কৃষিনির্ভর পরিবেশ, মাটি, মানুষ আর প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক।