ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক শাহজাহান আলী। প্রায় পাঁচ মাস আগে তিনি কেন্দ্রের জন্য দুটি ব্যায়ামের সাইকেল কিনতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগাম ৫৫ হাজার টাকা নেন। এতদিন টাকা পকেটে নিয়ে ঘুরলেও সাইকেল কেনেননি। বিষয়টি জানতে বৃহস্পতিবার তাঁর দপ্তরে গেলে শাহজাহান তড়িঘড়ি একজনকে ফোনে শুক্রবারের মধ্যে সাইকেলের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। পাশেই বসা কেন্দ্রের উপদেষ্টা অধ্যাপক অসীম কুমার সরকারও তাতে সায় দেন।

সাইকেল না কেনার ছোট্ট ঘটনায় অতীতে অনেক পদক-পুরস্কার অর্জনে এগিয়ে থাকা ঢাবির শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের বর্তমান ভঙ্গুর দশা বোঝানো যাবে না। সর্বশেষ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় ‘শৃঙ্খলা পদক’ ছাড়া কোনো পদকই পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়টি। সে সময় ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বলে উপস্থিত অনেকে জানিয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়, হল ও বিভাগের গুটিকয়েক প্রতিযোগিতার আয়োজন ছাড়া বছরজুড়ে শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের কোনো কার্যক্রম নেই। অথচ উপদেষ্টা-পরিচালক ছাড়াও পূর্ণকালীন প্রশিক্ষক আছেন ১২ জন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাইরে বিভিন্ন ক্লাবে চুক্তিভিত্তিক কোচের দায়িত্বে আছেন। জুডো-কারাতে, সুইমিংসহ কয়েকটি কার্যক্রম সারাবছর চললেও, বাইরে থেকে প্রশিক্ষক এনে ক্লাস নেওয়া হয়। পূর্ণকালীন প্রশিক্ষকদের পান না শিক্ষার্থীরা। এসব বিষয় স্বীকার করেছেন পরিচালক ও উপদেষ্টা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে এলে শাহজাহান আলী মাঝেমধ্যেই তাঁদের বলেন– এত খেলাধুলা করে কী হবে? পড়াশোনা কর, বিসিএসে মনোযোগ দাও। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষার্থীদের সাঁতারের জন্য বরাদ্দ ও মাঠ ভাড়ার টাকা আত্মসাতের কারণে প্রশাসন শাহজাহানকে শোকজ করেছিল। বিষয়টি নজরে আনলে শুক্রবার এই প্রতিবেদককে শাহজাহান আলী বলেন, ‘এসব খবরও তোমার কাছে আছে? তুমি এক সময় আসো। সামনাসামনি কথা বলব। তুমি আমাকে চিন?’ এরপর কল কেটে দেন তিনি।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উড়োজাহাজ ভাড়া বহনের শর্তে ‘ইউনিভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস ফেস্টিভ্যালে’ অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানায় আয়োজক রাশিয়া। অংশগ্রহণে সে সময় ১১ লাখ টাকা খরচ নির্ধারণ করে কোষাধ্যক্ষকে চিঠি দেয় শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র। পরে আয়োজকরা উড়োজাহাজ ভাড়াসহ সব খরচ বহন করবে উল্লেখ করে ঢাবি কর্তৃপক্ষকে ২৭ মের মধ্যে জানাতে বলে। কিন্তু এ বিষয়ে উপদেষ্টা ও ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কোনো ব্যবস্থা নেননি।

বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীরা গত বুধবার কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করেন। কোষাধ্যক্ষ ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত পরিচালককে বললে ফিরতি চিঠি লিখে শাহজাহান আলী বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় নেই। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে প্রতিযোগী পাঠানো ঝুঁকিপূর্ণ।’ চিঠিতে কেন এমন কথা লিখেছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় না থাকলে তো না-ই বলব। অফিসিয়ালি এখন এত কথা বলতে পারব না। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’

এক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, তাঁদের মধ্যে জাতীয় র‍্যাংকধারী, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গোল্ড ও ব্রোঞ্জজয়ী শিক্ষার্থী আছেন। ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের মুখে এমন কথা মানায় না। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে, সেখানে আমরা যাওয়ার জন্যই দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

জানতে চাইলে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও স্পোর্টস বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘আমি সবকিছু প্রস্তুত করে রেখেছি। শুক্রবার রাতের মধ্যেই অংশগ্রহণের বিষয়ে ই-মেইল পাঠানো হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শারীরক শিক্ষাকেন্দ্রের উপপরিচালক আজাদ রহমান বাফুফের হেড অব রেফারিজের দায়িত্বে আছেন। উপপরিচালক এস এম জাকারিয়া পিন্টু আবাহনীর চুক্তিভিত্তিক কোচ। সহকারী পরিচালক আবু ফয়সল আহমদ বসুন্ধরা কিংসের সাবেক কোচ। এ ছাড়া বিভিন্ন স্কুলের ক্লাবে প্রশিক্ষকরা কোচিং করান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে না জানিয়েই। প্রশিক্ষকদের বাইরে কাজের বিষয়ে শাহজাহান বলেন, ‘আমি অফিসপ্রধান। আমি জানি, অফিস চালাতে কত ধরনের অভিজ্ঞতা হয়। কেউ কেউ রোজ সকালে কোচিং করাতে যান। এসব কানে এলেও কাগজ নেই। আমার কী করার আছে?’

অনুমতির বিষয়ে উপপরিচালক এস এম জাকারিয়া সমকালকে জানান, ফোনে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। সরাসরি অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। আজাদ রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়কে জানানো হয়নি। তবে জিজ্ঞেস করলে সবই বলব।’

কেন্দ্রের উপদেষ্টা অসীম কুমার সরকার বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি ছাড়া এভাবে কাজ করা নিয়মসিদ্ধ নয়। দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সারাবছর কেন্দ্রে কোনো কার্যক্রম নেই, এটা ঠিক। তবে আমরা কিছু উদ্যোগ নিচ্ছি।’