- অফবিট
- 'শয়তানের পূজারি' ইয়াজিদি জনগোষ্ঠীর রহস্যময় সংস্কৃতি
'শয়তানের পূজারি' ইয়াজিদি জনগোষ্ঠীর রহস্যময় সংস্কৃতি

ছবি: বিবিসি
আরব দেশগুলোতে যেখানে ইসলামের জন্ম হয়েছে, সেখানেই আজও টিকে আছে পুরাতন ধর্ম ইয়াজিদি। ইয়াজিদি এমন এক সম্প্রদায় যারা নিজেদের ঐতিহ্য এবং স্বতন্ত্র ধর্ম পরিচয়কে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেও ধীরে ধীরে পৃথিবীর বুক থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এদের অত্যন্ত পবিত্র স্থান ‘লালিশ’। তারা লালিশকে মুসলিমদের ‘মক্কা’, খ্রিস্ট্রানদের জেরুজালেমের মতোই পবিত্র বলে মনে করে। লালিশ একটি ছোট্ট পাহাড়ে গড়ে উঠা গ্রাম। যেটি ইরাকের কুর্দিস্তানে (ইরবিল থেকে ১২৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে) অবস্থিত। অথচ সবুজে ঘেরা এই ছোট্ট পাহাড়ে মাত্র ২৫ জনের বাস। সেখানে ইয়াজিদিদের প্রধান ধর্মীয় নেতারা সবাই বাস করেন।
সাত হাজার বছরের পুরোনো এই ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারীর সংখ্যা বিশ্বব্যাপী সাত লাখ। এদের অনেকে জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক এবং অস্ট্রেলিয়াতে পুনর্বাসিত হয়েছে। অনেকে বিশ্বের অন্যান্য শরণার্থীদের সাথে মিশে এখনো উন্নত দেশগুলোতে আশ্রয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর হাজার হাজার ইয়াজিদি বাস করছে ইরাক আর সিরিয়ার শরণার্থী ক্যাম্পে।
ইয়াজিদি ধর্ম বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মীয় ঐতিহ্যের একটি। ‘ইয়াজিদি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল ‘আল্লাহর উপাসক’। এই শব্দটি মূলত ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ইয়াজিদিরা তাদের দেবতাকে ‘ইয়াজদান’ বলে ডাকে।
ইয়াজিদিজম কী?
ইয়াজিদিরা বিশ্বাস করে যে ইয়াজিদিজম বা ইয়াজিদিবাদ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীনতম ধর্ম এবং ইসলাম, খ্রিষ্টধর্মের কিছু কিছু বিষয় এক হওয়ায় এই ইয়াজিদি ধর্ম এই দুই ধর্মের মতোই অনন্য।
ইয়াজিদিরা বিশ্বাস করে, ঈশ্বর এই পৃথিবী আর আদম-হাওয়াকে সৃষ্টি করতে সাহায্য করার জন্য সাতজন ফেরেশতা সৃষ্টি করেন। এরপর ঈশ্বর এই সাতজন ফেরেশতাকে বললেন, `তোমরা আদমের সামনে মাথা নত করো'। একজন বাদে বাকি ছয়জন ফেরেশতা ঈশ্বরের আদেশ পালন করলো। যে ফেরেশতা মাথা নত করলোনা ঈশ্বর তাকে পৃথিবীতে নির্বাসিত করলেন ময়ূর বেশে এবং সে `মালাইকা আত-তাউস' (ময়ূর ফেরেশতা) নামে পরিচিত হলো। পরবর্তীতে ঈশ্বর এই ফেরেশতাকে সকল ফেরেশতা এবং পৃথিবীতে মানুষের দায়িত্ব দেন।
এটিই মূলত ইয়াজিদিদের উপর নিপীড়ণের মূল কারণ যেখানে দেখা যায় ইয়াজিদিরা একজন পতিত ফেরেশতাকে উপাসনা করে। ইসলাম এবং খ্রিষ্ট ধর্মমতে `শয়তান' হচ্ছে সেই পতিত ফেরেশতা এবং অনেক মানুষ বিশ্বাস করে ইয়াজিদিরা তাহলে শয়তানের উপাসক।
কিন্তু ইয়াজিদিদের মতে, ইয়াজিদিরা শয়তানে বিশ্বাস করে না এবং শয়তান পাপের উৎস একথাও মানতে নারাজ। এদের বিশ্বাস ঈশ্বর প্রদত্ব সমস্ত ভালো কিছুই মানুষের জন্য এবং মন্দ যা তা সব মানুষেরই কাছ থেকে আসে।
ইয়াজিদিরা ঈশ্বরকে এত পবিত্র মনে করে যে তারা সরাসরি তার উপাসনাও করে না। তাদের মতে, ইয়াজদান সমগ্র মানব সৃষ্টির স্রষ্টা, তবে তিনি মহাবিশ্বকে রক্ষা করেন না, এই কাজটি তার অবতার দ্বারা করা হয়, যাতে ময়ূর ঈশ্বর প্রধান হুহ। ইয়াজিদিরা ময়ূরের দেবতার পাশাপাশি তার ময়ূরের পালককেও পূজা করে।
ইয়াজিদিদের আরেকটি ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে তারা প্রকৃতি পূজারী। তাদের মন্দিরের ফটকে একটি কালো রঙের সাপের প্রতিকৃতি থাকে। যাকে তারা ‘প্রকৃতির মা’ হিসেবে বিবেচনা করে। তারা কখনও সাপ হত্যা করে না, এমনকি সেটি বিষাক্ত হলেও।
ইয়াজিদি ধর্মমতে অন্য ধর্মের কেউ ইয়াজিদি ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে না। ইয়াজিদি হতে হলে তাকে ইয়াজিদি বাবা-মার সন্তান হতে হবে। এর মানে হলো কেউ ইয়াজিদি না হলে ইয়াজিদি হতে পারবে না। ধর্মীয় আরও কিছু প্রথা এই ধর্মকে দিন দিন সংকুচিত করে ফেলছে যার মধ্যে রয়েছে এদের বিবাহ নিজেদের ধর্মের মধ্যেই হতে হবে।
ইয়াজিদিদের প্রার্থনা কেমন?
ইয়াজিদিরা দৈনিক পাঁচবার প্রার্থনা করে। নিভেজা বেরিস্পেদে (ভোরের প্রার্থনা), নিভেজা রোঝিলাতিনে (সূর্যোদয়ের প্রার্থনা), নিভেজা নিভ্রো (দুপুরের প্রার্থনা), নিভেজা এভারি (বিকেলের প্রার্থনা), নিভেজা রোজাভাবুনে (সূর্যাস্তের প্রার্থনা)। তবে বেশিরভাগ ইয়াজিদি মাত্র দুই বারই প্রার্থনা করে আর তা হলো সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তর সময়। এই দুই সময় এরা সূর্যের দিকে এবং বাকি সময় গুলো লালিশের (যেখানে এদের পবিত্র মন্দির অবস্থিত) দিকে মুখ করে প্রার্থনা করে। এই দৈনিক প্রার্থনা বাইরের লোকেদের উপস্থিতিতে করা নিষিদ্ধ। বুধবার হচ্ছে ইয়াজিদিদের পবিত্র দিন এবং শনিবার হলো বিশ্রামের দিন।
ইয়াজিদিদের উৎসব কেমন?
ইয়াজিদিদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি হচ্ছে ইরাক এর উত্তর মসুলের লালিশে অবস্থিত শেখ আদি ইবনে মুসাফির (শেখ সাদী) এর মাজারে সাতদিনের হজ্বব্রত বা তীর্থভ্রমণ পালন। যদি সম্ভব হয় প্রত্যেক ইয়াজিদি তাদের জীবদ্দশায় একবার শেখ সাদীর মাজারে তীর্থভ্রমণের চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। তীর্থভ্রমণের সময় তারা নদীতে গোছল করে। তাউস মেলেকের মূর্তি ধৌত করে এবং শেখ সাদীর মাজারে শত প্রদীপ জ্বালায়। এসময় তারা একটি ষাঁঁড় কুরবানি করে।
ব্যাপ্টিস্ট খ্রিষ্টানদের মতো ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের শিশুদের সর্বাঙ্গ পবিত্র পানিতে ডুবিয়ে দীক্ষা দেন একজন পীর। ডিসেম্বর মাসে ইয়াজিদিরা তিন দিন রোজা রাখে। পরে পীরের সঙ্গে সুরা পান করে।
ইয়াজিদিরা কেন নির্যাতিত?
মূলত ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের লোকজন নিপীড়ণের লক্ষ্য হয়েছে। তবে এই নিপীড়ন সবসময় সহিংস রূপে ছিলোনা। এদের ভূমি থেকে উচ্ছেদও এদের প্রতি নিপীড়ণের একটা কারণ। ধর্মীয় বিচার ছাড়াও আরেকটি কারণে ইয়াজিদিরা নিপীড়িত হয়েছে আর তা হলো সাদ্দাম হোসেন কর্তৃক উত্তর ইরাকে আরব বসতি বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে অনারব ইরাকিদের বাস্তুচ্যুত করার চেষ্টা।
সূত্র: বিবিসি, ইনফো টেক লাইফ ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
মন্তব্য করুন