ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩

আন্তর্জাতিক

পাকিস্তানের গণতন্ত্র কোন দিকে যাচ্ছে?

পাকিস্তানের গণতন্ত্র কোন দিকে যাচ্ছে?

আইলিয়া জেহরা

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৩ | ০২:২৯

লাহোরের এক শীতের সকালের সেই ঘটনা এখনও আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। সেদিন আমাকে প্রথমবারের মতো জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমি কোনটা বেছে নেব– রিপোর্টিং, নাকি বেঁচে থাকা? অপরিচিত নম্বর থেকে কল করে আমাকে বলা হয়, ‘এই রিপোর্টিং কি আপনার কাছে আপনার জীবনের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ?’ এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে আমি একটি রিপোর্ট করেছিলাম ২০১৯ সালে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের পাকিস্তান সফর উপলক্ষে সংবাদমাধ্যমের ওপর আরোপ করা সরকারি সেন্সরশিপ বিষয়ে। হুমকিটি ভীতিকর ছিল, কিন্তু সেটি আমি গায়ে মাখিনি। স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই নিয়েছিলাম।

পাকিস্তানে তেহরিক-ই-ইনসাফ পিটিআই সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচনাকারী সাংবাদিক ও সামাজিক কর্মীদের এই ‘অপরিচিতরা’ ক্রমাগতভাবে নিশানা বানিয়েছিল এবং ফোন করে তাদের হয়রানি করছিল। যদিও সামরিক বাহিনীই প্রধানত এই দমনচেষ্টার জন্য দায়ী; পিটিআই এ অবস্থা তৈরি করেছিল। পিটিআই ক্ষমতার নেশায় মত্ত ছিল: মন্ত্রীরা টিভি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তাদের সমালোচকদের হুমকি দেওয়ার সময় ক্ষমতাসীন দল ও সামরিক বাহিনী যে ‘একই সত্তা’– তা নিয়ে গর্ব করত। এক মন্ত্রী পাকিস্তানকে সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে জনসমক্ষে ৫০০০ মানুষকে ফাঁসি দিতে চেয়েছিলেন। যে সাংবাদিকরা শারীরিক হামলা ও হত্যাচেষ্টার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তাদের মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিল।

বিশেষত নারী সাংবাদিক ও সমাজকর্মীরা অপপ্রচারের নিশানা ছিলেন। ফটোশপে ছবি বিকৃত করা, বিভিন্ন মিম তৈরি করা, অবমাননাকর হ্যাশট্যাগ দেওয়া এবং ধর্ষণের হুমকি দেওয়া ছিল নিয়মিত ঘটনা। এসব আক্রমণ কেবল সামাজিক মাধ্যমে সীমিত ছিল না। আমিসহ অনেক নারী সাংবাদিককে বাস্তব জীবনেও হুমকি দেওয়া হয়। ভয়ের পরিবেশ বজায় থাকায় আমরা এসব ঘটনা নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলিনি। অনেক ঘটনাই বলা হয়নি।

পিটিআই সরকারের সময় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্র সংকটে পড়ে। এ কারণে যখন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট সফল হয় তখন আমরা অনেকেই আশাবাদী ছিলাম, দেশে বুঝি গণতন্ত্র ফিরে আসবে। নতুন সরকারের প্রথম কয়েক সপ্তাহে আমরা আশাবাদী হওয়ার কারণও দেখেছিলাম। তবে শিগগিরই সেই আশা নিরাশায় পরিণত হয়।

আগের সেনাশাসনবিরোধী অবস্থান পাল্টে ক্ষমতাসীন জোট পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (পিডিএম) দলগুলো সেনাতোষণে লেগে গেল। ক্ষমতা গ্রহণের দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ প্রশাসনে বেসামরিক কর্তৃত্বের পক্ষে তাঁর দলের অবস্থান দেখে সরে এসে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে সরকারি কর্মচারী নিয়োগের আগে যাচাই-বাছাইয়ের অনুমতি দেন। এর পর তিনি এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেন, যা পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে দুর্বল করে।

পিডিএমের গুরুত্বপূর্ণ শরিক পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ এর আগে সংসদকে সবার ওপরে স্থান দেওয়ার বিষয়ে সোচ্চার ছিল। কিন্তু পিডিএম সরকারই বিতর্কিত নানা বিল পাস করতে সংসদের সেই মর্যাদাকে হেয় করে। সামরিক বাহিনীর সমালোচকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করে। গভীর রাতে অভিযান চালিয়ে বাড়ি থেকে রাজনৈতিক কর্মীদের তুলে নেওয়া হয়। পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের অন্ধকার সময়ে যে অধ্যাদেশ রচিত হয়, সেগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দমনে ব্যবহৃত হয়।

অন্তর্বর্তী সরকার সেনাবাহিনীর বি-টিম হিসেবে কাজ করছে, তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার-উল-হক কাকার রাখঢাক না করে গর্ব করেই বলেছেন, এ নিয়ে তাঁর কোনো অস্বস্তি নেই যে, তিনি সামরিক বাহিনীর পছন্দে এ পদে আছেন।

৯ মে ইমরান খানের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে যে দাঙ্গা হয়, সেটি ছিল পাকিস্তানের গণতন্ত্রের কফিনে ঠোকা শেষ পেরেক। পিটিআই কর্মীরা যেভাবে সামরিক বাহিনীর কমান্ডারদের বাড়িতে হামলা করে, তাতে আইনের প্রতি পিটিআইর অশ্রদ্ধাই ফুটে ওঠে। দলটি হয়তো ভেবেছিল, এমন প্রতিক্রিয়ায় তাদের কোনো সমস্যা হবে না। আসলে তারা বুঝে উঠতে পারেনি যে, তারা এখন আর সামরিক বাহিনীর পছন্দের তালিকায় নেই। আর তাদের এ না-বোঝাটাও বিস্ময়কর কিছু নয়। কারণ, সামরিক বাহিনীর মূল পরিকল্পনা ছিল ইমরান খানকে কয়েক বছর যে কোনো প্রকারে ক্ষমতায় রাখা।

পাকিস্তানে ৯ মের ঘটনার পর বেসামরিক মানুষের স্বাধীনতা নতুন করে হুমকির মুখে পড়ে। কিন্তু ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর পরিবর্তে ইমরান খান ও অন্য পিটিআই নেতারা ৯ মের দাঙ্গাবাজদের থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেন এবং সামরিক আদালতে তাদের বিচারের বিরোধিতাও করেননি। দলের সমর্থকদের সামরিক আদালতের বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পিটিআই ব্যর্থ। পিটিআইর বাইরে যেমন পশতুন তাহাফুজ মুভমেন্ট (পিটিএম) সম্প্রতি একই রকম নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান নিয়েও কথা বলেনি পিটিআই। এটি প্রমাণ করে, দলটি অতীত থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি।

দলটি যে রাজনৈতিক অপরিপক্বতা দেখিয়ে চলেছে, তা সত্ত্বেও জাতীয় নির্বাচনের আগে পিটিআইর বিরুদ্ধে অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিবাদে গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বরগুলোর নিন্দা জানানো উচিত। পাকিস্তানের এখন তীব্রভাবে গণতন্ত্রের জন্য নতুন এক সনদ– গণতন্ত্র ২.০– প্রয়োজন, যাতে নাগরিক স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ প্রতিহত করা যেতে পারে এবং দেশটি সংকট থেকে উত্তরণের পথে হাঁটতে পারে।  

আইলিয়া জেহরা: পাকিস্তানি সাংবাদিক; দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

আরও পড়ুন