অন্যদৃষ্টি
হেফাজতে মৃত্যু কি চলবেই?

তানিয়া খাতুন
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৩ | ১১:১৭
বর্তমানে দেশে ক্রসফায়ার হ্রাস পেলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু থেমে নেই। চলতি মাসে পুলিশ হেফাজতে এক দিনে ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে দুই ব্যক্তির মৃত্যুর বিষয়টি আইনের প্রতি পুলিশের শ্রদ্ধা, তাদের নীতিনৈতিকতা ও দায়িত্ববোধকেই যেন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
খবরে প্রকাশ, গত ৩ অক্টোবর সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে বগুড়ায় ৬০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধার বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততা জানতে পেরে বগুড়ার আদালত ফটক থেকে হাবিবুর রহমান হাবিব (৩৬) নামে আইনজীবীর একজন সহকারীকে (মুহুরি) সাদা পোশাকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে বিনা পরোয়ানায় তুলে নিয়ে যায়। একই দিন রাত পৌনে ৯টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাবিবুর মারা যান। আটকের তিন ঘণ্টার মধ্যে হাবিবুরের মৃত্যু হয়। অথচ পরিবারকে হাবিবুরের আটক বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। আটকের বিষয়ে কোনো তথ্য না দেওয়া, লাশ দেখতে না দেওয়া এবং বিনা পরোয়ানায় আটক– সর্বক্ষেত্রে হাবিবুর ও তাঁর পরিবারের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। একই দিনে রাত ১১টার দিকে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার দু’জন সহকারী উপপরিদর্শক সাদা পোশাকে বিনা পরোয়ানায় সৈয়দ মোহাম্মদ শহিদুল্লাহকে ধস্তাধস্তি করে থানায় নিয়ে যায়। থানায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন হৃদরোগে আক্রান্ত এবং সময়মতো তাঁর ইনহেলার ও ওষুধের প্রয়োজন হয়। অথচ পুলিশ তাঁর কাছে ইনহেলার ও ওষুধ পৌঁছাতে দেয়নি। পরে পুলিশ রাত ১২টার দিকে সৈয়দ মোহাম্মদ শহিদুল্লাহকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্যানুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে পাঁচজন এবং র্যাব হেফাজতে একজন নারীসহ মোট ছয় ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। এদের মধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে একজন পুলিশ হেফাজতে ও একজন নারী র্যাব হেফাজতে মারা গেছেন বলে পরিবারের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন। একজনের মৃত্যুর ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেটের সুরতহাল প্রতিবেদনে আত্মহত্যার আলামত উল্লেখ থাকলেও হাসপাতালের মৃত্যুসনদে চিকিৎসক হৃদরোগে আসামির মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। পুলিশের ভাষ্যমতে, বাকি তিনজন অসুস্থতাজনিত কারণে মারা গেছেন।
দুটি মৃত্যুতেই পুলিশের কার্যক্রমে শুধু আইনের লঙ্ঘন নয়, মানবিক গুণাবলির অনুপস্থিতিও লক্ষণীয়। আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে পুলিশ– যারা রাষ্ট্রের পক্ষে অপরাধের প্রতিকারে মূল ভূমিকা পালন করবে, তারা নিজেরাও নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাহসও হারিয়ে ফেলছে।
বাংলাদেশে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩-তে একটা সুন্দর প্রারম্ভিক কথা আছে। এই মুখবন্ধে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইনটির মুখবন্ধে আরও আছে– বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৯৮৪ সালে গৃহীত নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার বা নির্যাতনবিরোধী সনদের একজন অংশীজন রাষ্ট্র। অর্থাৎ আমাদের সংবিধান এবং জাতিসংঘের এই সনদ বাস্তবায়নের জন্য নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এ আইনে বিচার হয়েছে মাত্র একটি। মিরপুর-১১ নম্বর সেক্টর থেকে ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ইশতিয়াক হোসেন জনি নামে এক যুবককে আটক করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে– এমন অভিযোগে তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে আদালতে মামলা করেন তাঁর ভাই। ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সেই মামলার রায়ে আদালত ওই তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। মামলাটি বর্তমানে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। তানিয়া খাতুন: হিউম্যান রাইটস মনিটরিং কর্মকর্তা, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন