ফিলিস্তিন
নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান যুদ্ধে জড়াতে সফল হবেন?

মারওয়ান বিশারা
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তিন দশক ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে সতর্কঘণ্টা বাজিয়ে আসছেন। অজস্রবার তিনি ইরানে হামলার হুমকি দিয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে, জাতিসংঘের ভাষণে তিনি বলেছেন, তেহরানকে অবশ্যই ‘বাস্তব পারমাণবিক হুমকি মোকাবিলা’ করতে হবে। পরে অবশ্য তাঁর দপ্তর সংশোধনী দিয়ে বলেছে, তিনি আসলে ‘বাস্তব সামরিক হুমকি’ বোঝাতে চেয়েছেন। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের পর নেতানিয়াহু হয়তো চূড়ান্তভাবে তাঁর হুমকি কার্যকরের সুযোগ পাবেন। হামাসের হামলায় দক্ষিণ ইসরায়েলে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে অজুহাত জুগিয়েছে এবং ব্যাপক পাল্টা-হামলার পক্ষে আন্তর্জাতিক সহায়তার ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
বাইডেনের এ সহায়তার কারণ রাজনৈতিকও হতে পারে। অর্থাৎ ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে যাতে বিরোধী রিপাবলিকান দল ইসরায়েলকে উপলক্ষ বানাতে না পারে। এরই মধ্যে রিপাবলিকানরা ইরানের সঙ্গে বাইডেনের বন্দি বিনিময় চুক্তি নিয়ে কথা তুলেছে। এ চুক্তির মাধ্যমে ইরান ৬ বিলিয়ন ডলার ছাড় পায়। তারা এর সঙ্গে হামাসের আক্রমণের সম্পর্ক থাকারও অভিযোগ করছে।
কিন্তু নেতানিয়াহু ও তাঁর গোঁড়া মন্ত্রীদের মনে হয়তো এর চেয়ে ভিন্ন কিছু রয়েছে। তাঁর সরকার এরই মধ্যে ইরানকে হামাসের অভিযানে মদদ ও নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ এনেছে। ইসরায়েলের অনেক সমর্থক ও নব্য রক্ষণশীল এবং সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মিডিয়া পণ্ডিতরাও এ হামলায় ইরানের সম্পর্ক থাকার কথা বলছেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা এখনও তেহরানের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পায়নি। ইরান বলেছে, আক্রমণটি ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার পদক্ষেপ। কর্মকর্তারা ইসরায়েলের দুরবস্থায় তাদের আনন্দ লুকানোর চেষ্টা করেননি। তারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন যে, এই হামলা সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা থামিয়ে দেবে।
এদিকে ইরানের মিত্র লেবানিজ হিজবুল্লাহ হামাসের হামলার প্রশংসা করেছে। হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের দখলকৃত শেবা ফার্মে হামলা চালায় এবং ইসরায়েল গাজায় প্রবেশ করলে আরও বড় আক্রমণের হুমকি দেয়। ইরান ও তার মিত্রদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তাদের সংকটে ফেলতে পারে, ইসরায়েলের দম্ভ যেমন হামাস যোদ্ধাদের হাতে ধুলায় মিশে গেছে। ইরান বা ইসরায়েল কোনো দেশই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিচ্ছে না। কারণ, তারা যুদ্ধের জন্য প্রক্সি সংঘাত অব্যাহত রাখছে। কয়েক বছর ধরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে নাশকতা চালিয়েছে এবং বিদেশে ইরানের সম্পদকে নিশানা করেছে। ইরান সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আক্রমণ করতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সহায়তা দিয়েছে। নেতানিয়াহু তাঁর গর্জন ও আত্মবিশ্বাস সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেত ও সমর্থন ছাড়া ইরানে হামলা করতে পারবেন না। তবে এ ধরনের হামলা অঞ্চলটিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। এর মাধ্যমে নেতানিয়াহু চালাকি করে বাইডেনকে যুদ্ধে জড়িয়ে ইরানকে ধুলায় মেশানোর বহুদিনের খায়েশ মেটানোর সুযোগ পেতে পারেন। তবে এটা সহজ হবে না। কারণ, বাইডেন প্রশাসন এরই মধ্যে চিরদিনের জন্য যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তা ছাড়া ২০২১ সালে আফগানিস্তান ছাড়ার সময় তারা যে অপদস্থ হয়েছে, সেটাও মনে থাকার কথা। পাশাপাশি বাইডেন প্রশাসন বিশেষত ইউক্রেনে হামলার পর থেকে চীন ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতার বিষয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়নি। দেশটি শুধু তার সৈন্য ও সামরিক সম্পদ এ অঞ্চল থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করেছে। বাইডেন নিজেও শপথ নিয়েছেন– ‘চীন, রাশিয়া ও ইরান যাতে শূন্যস্থান পূরণ করতে না পারে, সে জন্য তিনি অন্য কোথাও যাবেন না।’
যখনই হামাসের হামলায় ইরানের ভূমিকার বিষয়টি ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করতে পারবে, তারা একে হামাসের বন্দিশালা থেকে ইসরায়েলি বন্দিদের বের করার উপলক্ষ বানাবে। কারণ, হামাস ইসরায়েলি যেসব ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গেছে, তাদের মুক্তির বিষয়টি নেতানিয়াহুর অগ্রাধিকারের শীর্ষে আছে। ইরান যদি অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহকে ব্যবহার করে, তা যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে এনে বৃহত্তর সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, ওয়াশিংটনের ভেজালের রাজনীতিতেও একমাত্র যে বিষয়ে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দল একমত, তা হলো ইসরায়েলকে নিঃশর্ত সমর্থন দান। এটা মনে রাখা জরুরি, ২০২৩ সালের পরিস্থিতি ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণে নেতৃত্ব দেওয়ার চেয়েও অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ও জটিল। ইরানের বিরুদ্ধে এর পুনরাবৃত্তি ঘটলে সেটি অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সবার জন্য আরও খারাপ ফল বয়ে আনবে। মারওয়ান বিশারা: জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক; আলজাজিরা থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান