ঢাকা বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩

পাশ্চাত্য

ব্রিটেনের পাপের মাশুল

ব্রিটেনের পাপের মাশুল

ফিলিস্তিনের গাজায় নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে ইসরায়েল। ছবি: এএফপি

জগলুল আসাদ

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৩ | ২১:৫১ | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৩ | ২১:৫১

ইসরায়েল নামের রাষ্ট্র গঠনে ব্রিটেন ও পরবর্তী সময়ে আমেরিকার যে ভূমিকা তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ হাজির করেছেন ঐতিহাসিকরা। সভ্যতার নিশানবরদার এই ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যিক শক্তির হাত ধরে কত কত অন্যায় যে সংঘটিত হয়েছে, তার হিসাব অগোচরেই রাখা হয়। আমরা ইসরায়েলি-ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আভি শ্লাইমের ইশারা ধরে জায়নিস্ট কলোনিয়াল প্রজেক্টে ব্রিটেনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার বিস্তার।

জায়নিস্ট রাষ্ট্র গঠনে ব্রিটিশদের ভূমিকার বিস্তারিত বর্ণনা পাই আভি শ্লাইমের ‘বেলফোর ঘোষণা এবং এর পরিণতি’ (The Balfour declaration and its consequences) নামক রচনায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটেন তিনটি চুক্তি করেছিল, যার প্রতিটি আরেকটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একটিকে মান্য করলে অন্যটি আপসেআপ বাতিল হয়ে যায়। যেমন– ১৯১৫ সালে ব্রিটেন শরিফ অব মক্কার সঙ্গে প্রতিশ্রুতবদ্ধ হলো যে, উসমানি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে আরবের শাসনক্ষমতা এবং ফিলিস্তিনও তাদের হাতে থাকবে। কিন্তু ১৯১৬ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোকে ভাগাভাগি করে নিজেদের প্রভাব বলয় বা Sphere of influence-এ আনার জন্য ব্রিটেন ফ্রান্সের সঙ্গে এক গোপন চুক্তি করে। চুক্তিটি সাইকস-পিকট নামে পরিচিত। এ চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ ইসরায়েল এবং ফিলস্তিন, জর্ডান, দক্ষিণ ইরাক ইত্যাদি অঞ্চল থাকবে ব্রিটেনের; আর ফ্রান্স নিয়ন্ত্রণ করবে সিরিয়া, লেবানন, ইরাকের উত্তরাংশ ইত্যাদি।

আবার ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য জাতীয় আবাসভূমি ‘National home for the Jewish’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে আরবদের পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত স্বাধীনতা দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি ব্রিটেন দিয়েছিল, এর সঙ্গে বেলফোর ঘোষণা পুরোই সাংঘর্ষিক। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর লেখেন, ‘ফিলিস্তিনের বর্তমান বাসিন্দাদের সঙ্গে আমাদের পরামর্শের প্রয়োজন নেই। জায়নিজম ভুল হোক বা শুদ্ধ, তা ৭ লাখ আরবের আশা-আকাঙ্ক্ষার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ অথচ আরবরাই ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ৯৪ শতাংশ। বেলফোর ঘোষণা নিয়ে দুই ধরনের মত আছে। একটা হিউম্যানিটারিয়ান স্কুল, আরেকটাকে বলে ইম্পেরিয়ালিস্ট স্কুল। মানবতাবাদী ঘরানা মনে করে, একটা প্রাচীন জনগোষ্ঠীকে তাদের পূর্বপুরুষদের সুপ্রাচীন ভূমিতে ফিরিয়ে দেওয়ার মহতী প্রচেষ্টা এটি। অন্যদিকে ইম্পেরিয়ালিস্ট স্কুল এ ঘোষণাকে ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী হিসাবনিকাশের ফল বলেই মনে করে। উল্লেখ্য, অধিকাংশ ঐতিহাসিকই মনে করেন, বেলফোর ঘোষণা ব্রিটেনের বৃহত্তর সাম্রাজ্যিক বিবেচনার ফল।

বেলফোর ঘোষণার সময় ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লয়েড জর্জ। যারা অটোমান সাম্রাজ্যকে ভেঙে কিছু ক্লায়েন্ট স্টেট বা তাঁবেদার রাষ্ট্র তৈরি করতে চেয়েছিল, তাদের নেতা ছিলেন লয়েড জর্জ। তা ছাড়া টম সেগেভের মতে, লয়েড জর্জের জায়নিজমকে সমর্থনের পেছনে জায়নিস্টদের প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে তাঁর একটা ভুল ও অতিরঞ্জিত ধারণা ছিল। তিনি মনে করতেন, ইহুদিদের রাশিয়া, আমেরিকা ও সাবটারেনিয়ান অঞ্চলে এদের প্রভাব আছে। তাঁর জানা ছিল না, জায়নিস্টরা জুইশ কমিউনিটির একটা ক্ষুদ্র অংশ। অনেক ইংরেজ ইহুদি জায়নিজমের ভেতরে যে অন্তর্গত জাতীয়তাবাদী চেতনা সেটার বিরোধী ছিলেন। লয়েড জর্জের মন্ত্রিপরিষদের একমাত্র ইহুদি সদস্য ছিলেন মন্টেগু। ব্রিটিশ ক্যাবিনেটে ‘বর্তমান সরকারের ভেতরে ইহুদিবিদ্বেষ’ (Anti-semitism of the present Government) শিরোনামে তিনি চার পাতার একটা স্মারকলিপি জমা দেন। যেখানে তিনি বলেন, জুডাইজম একটা ধর্ম, এটি কোনো জাতি নয়। ইহুদিবাদী রাষ্ট্র তৈরি করার কোনো অর্থ হয় না। ফিলিস্তিনের ইহুদি রাষ্ট্র ব্রিটেন, আমেরিকা বা অন্যান্য জায়গায় বসবাসকারী ইহুদিদের সমানাধিকারের বিরুদ্ধে।

আভি শ্লাইম বেলফোর ঘোষণাকে আরবের প্রাণকেন্দ্রে ইহুদি রাষ্ট্রকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রতীক বলেছেন। ফিলিস্তিনি আরব জনগোষ্ঠীকে ভিটেমাটি ছাড়া করার জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কনিষ্ঠ দোসর ছিল এই জায়নিজম। কারণ জায়নিজমের লক্ষ্যই ছিল, ইউরোপীয় ইহুদিদের ফিলিস্তিনে এনে বসতি গড়া। আবার ব্রিটিশদের লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখা, সে ক্ষেত্রে জায়নিজম ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ উপস্থিতিকে জায়েজ করবে। এভাবে তারা একে অপরের সহযোগী হয়ে থাকে।

তবে ঐতিহাসিকরা দেখান, জায়নিজমকে সমর্থন ছাড়াই অর্থাৎ ইসরায়েলে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনে তৎপরতা ছাড়াই তারা তাদের প্রভাব ধরে রাখতে সক্ষম ছিল। কারণ আরবরা ইতোমধ্যে ব্রিটিশদের মিত্র ছিল। আরব অঞ্চল তুর্কি খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে রাজিও ছিল, সে ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনকে তাদের অধীনে রাখলে ব্রিটিশ প্রভাব অক্ষুণ্ণ থাকত। তাই ব্রিটিশ স্বার্থের জন্য বেলফোর ঘোষণা ছিল ‘এক সাংঘাতিক কৌশলগত ভুল’। আভি শ্লাইম দাবি করেন, বেলফোর ঘোষণা একই সঙ্গে অপরাধ ও ভুল। ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে এটি ছিল ব্রিটেনের অপরাধ, আর ব্রিটিশ পলিসির দিক থেকে এটি ছিল একটা ভুল। কারণ এর ইতিবাচক ফল ব্রিটিশ শাসন ভোগ করতে পারেনি।

ইসরায়েলের পুরোনো ধারার ইতিহাসবিদরা বলেন, শেষ দিকে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু ইলান পেপের নেতৃত্বে ইসরায়েলের সংশোধনবাদী ধারার ইতিহাসবিদরা দলিল-প্রমাণসহকারে দেখান ব্রিটেন ইসরায়েল রাষ্ট্রের অভ্যুদয়কে সমর্থন করেছে এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের উদ্ভবকে সবসময় বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে।

জগলুল আসাদ: শিক্ষক এবং সম্পাদক ‘চিন্তাযান’ 

আরও পড়ুন