ভারতবর্ষের মাটিতে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে। সে সময় কংগ্রেসের নেতৃত্বে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রাম চলছিল। কমিউনিস্টরা সেই আন্দোলনের মধ্যে থেকেই ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলে ধরেছিল। কংগ্রেস দলের বিভিন্ন অধিবেশনে কমিউনিস্ট নেতা অনুপ ভ্যালি চেষ্টিয়ার এবং হসরত মোহানী পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উপস্থাপন করেন। অবশ্য গান্ধী সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, দেশবাসী তখনও স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়নি। কিন্তু কমিউনিস্টরা স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রচার অব্যাহত রাখেন। কমরেড মণি সিংহ তার সাথীদের নিয়ে ওইসব প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন। নেতাজি সুভাষ বোস ওই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ফলে তা আরও ব্যাপক ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জন করাটাই যথেষ্ট ছিল না। বিদেশি শোষকদের পরিবর্তে দেশীয় শোষকরা ক্ষমতায় এলে সাধারণ মানুষের মুক্তি আসবে না। তাই কমিউনিস্টরা শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষকে সংগঠিত করে আন্দোলনে মনোনিবেশ করেন। মণি সিংহ কলকাতার মেটিয়াবুরুজে শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি শ্রমিকদের একান্ত আপনজন হয়ে ওঠেন। সেখানে শ্রমিকদের এক সভায় নেতাজি সুভাষ বোসের সঙ্গে একই মঞ্চে এক তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হন। শ্রমিকরা মণি সিংহকেই সমর্থন জানান। মণি সিংহ একবার ময়মনসিংহের সুসং দুর্গাপুরে তার মামার বাড়িতে বেড়াতে যান। তার মামা ছিলেন সেখানকার জমিদার। সেখানে যাওয়ার পর কৃষকরা যখন মণি সিংহের শ্রমিক আন্দোলনের কথা জানল, তখন তারা মণি সিংহের সঙ্গে দেখা করল। ওই কৃষকদের ওপর তখন টংক বা ফসলি খাজনার অত্যাচার চলছিল। কৃষকরা মণি সিংহকে এই অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বলল। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনের দায়িত্বে আছেন বলে তিনি রাজি হলেন না। পরে তিনি চিন্তা করলেন, তার মামা ও নিজ স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়তে হবে বলেই বোধ হয় তিনি কৃষকদের সঙ্গে মিলে সংগ্রাম করতে রাজি হচ্ছেন না। লেনিন বলেছিলেন, মেহনতি মানুষের সঙ্গে এক হতে হবে। মণি সিংহ মনে মনে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তিনি কৃষকদের নিয়ে আন্দোলনে ব্রতী হলেন।
ওই সময় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে যোগসাজশে ব্রিটিশ সরকার ভারতকে দুই ভাগে ভাগ করল। কমিউনিস্ট পার্টি এই সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব মানেনি। তারা আওয়াজ তুলল : 'ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।' পূর্ব বাংলায় আন্দোলন গড়ে উঠল। রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, সিলেট প্রভৃতি অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন বেশ জোরদার হয়ে উঠল। সুনির্দিষ্টভাবে ওই আন্দোলন তেভাগা আন্দোলনে রূপ নিল। ময়মনসিংহে এই আন্দোলন টংক এবং সিলেটে নানকার আন্দোলনে রূপ নিল। কিন্তু এলাকায় অনেকখানি সশস্ত্র গণসংগ্রামে রূপ নেয়। নির্বাচনে দমন-পীড়ন মোকাবিলা করে শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন জয়যুক্ত হয়। জমিদারতন্ত্র ভেঙে পড়ে। মণি সিংহের জমিজিরাত বেদখল হয়ে যায়। তার বসতভিটা ভেঙেচুরে লাঙ্গল দেওয়া হয় এবং তার নামে হুলিয়া জারি করা হয়। মণি সিংহ আত্মগোপনে চলে যান। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
মণি সিংহ, খোকা রায়, মণি কৃষ্ণ সেন, আলতাফ আলী, হাতেম আলী খান, জ্ঞান চক্রবর্তীসহ অনেকের প্রচেষ্টায় চরম নির্যাতন মোকাবিলা করে সারাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। পার্টি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলে। একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলনও জোরদার হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাই পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অচিরেই তাদের ভুল ভাঙতে থাকে। তারা বুঝতে পারেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছে। ১৯৫৪ সালে কমিউনিস্টদের উদ্যোগেই হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী চক্রান্ত করে অল্পদিনের মধ্যেই যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটায়। এরপর একের পর এক চক্রান্ত চলতে থাকে। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী জেনারেল ইস্কেন্দার মির্জার সঙ্গে আপসরফা করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। আপসের শর্ত ছিল আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যাগ করবে এবং সিয়াটো, সেন্টোসহ পাক-মার্কিন চুক্তি সমর্থন করবে। আওয়ামী লীগের মধ্যে কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা জাতির সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নিতে পারেনি। দল ভেঙে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়। ন্যাপ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সারাদেশে আন্দোলন গড়ে তোলে। অত্যাচারের মধ্যেও তারা নীতির প্রশ্নে কোনো আপস করেনি। এক্ষেত্রে মণি সিংহের দৃঢ়তা ও দূরদৃষ্টির একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল।

সারাদেশে সাধারণ নির্বাচন আসন্ন হয়ে এসেছিল। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল যে, নির্বাচন হলে বামপন্থিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার সম্ভাবনাই বেশি। এই আশঙ্কায় সিআইএর সঙ্গে চক্রান্ত করে তারা কেন্দ্রীয় সরকার বাতিল করে সামরিক শাসন জারি করে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হন। কিন্তু আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেও ধীরে ধীরে আন্দোলন গড়ে ওঠে। সোহরাওয়ার্দীর আপস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনোদিন পছন্দ করেননি। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ সাহেব সোচ্চার হয়ে উঠলেন। বিশেষত ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ববাংলার অরক্ষিত অবস্থা দেখে দেশবাসীর যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তারই প্রেক্ষাপটে শেখ সাহেব ছয় দফা বা স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন। এই দাবিতে ৭ জুন হরতাল পালিত হয়। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি হরতালের প্রতি সমর্থন জানায়। অবশ্য পিকিংপন্থিরা বিরোধিতা করে। একপর্যায়ে শেখ সাহেবসহ আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ
নেতা গ্রেপ্তার হয়ে যান এবং মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়।
১৯৬১ সালে ঢাকার কাকরাইলে মণি সিংহ ও শেখ মুজিবের মধ্যে এক গোপন বৈঠক হয়। একাধিক বৈঠকের পর আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। উভয় নেতা একমত হন যে, চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। এই সমঝোতার ভিত্তিতে '৬২-র শিক্ষা আন্দোলন সংগঠিত হয়। শ্রমিক কৃষকসহ ব্যাপক জনগণের আন্দোলন গড়ে ওঠে। ৬ দফাসহ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও প্রগতিশীল এগারো দফা আন্দোলন স্বৈরাচারের ভিত্তি কাঁপিয়ে তোলে। ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। শেখ মুজিব, মণি সিংহসহ সব রাজবন্দি মুক্তি পান।
কমরেড মণি সিংহ ১৯৬৯-এর পহেলা মে মিরপুরে এক নির্মাণাধীন বাড়িতে গোপন সমাবেশে ঘোষণা করেন : আর্মড স্ট্রাগল ইজ অন আওয়ার এজেন্ডা অর্থাৎ আমাদের সামনে এখন সশস্ত্র সংগ্রাম। পার্টি সেই সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করার আহ্বান জানায়। এভাবে প্রতিটি আন্দোলনের মধ্যে থেকে মণি সিংহ আন্দোলনের ভবিষ্যতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। ১৮৮৬ সালে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে ঘোষণা করা হয় : আন্দোলনের বর্তমানে থেকে কমিউনিস্টরা আন্দোলনের ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব করে। কমরেড মণি সিংহ ছিলেন সেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাচ্চা প্রতিনিধি। তাই কখনও তিনি আর্দশিক রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হননি। কমরেড মণি সিংহ আর্দশ রাজনীতির প্রতীক। ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার প্রয়াণ হয়। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তাকে।
উপদেষ্টা, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি

বিষয় : কমরেড মণি সিংহ আদর্শ রাজনীতির প্রতীক

মন্তব্য করুন