স্মরণ
আপন ঘরে বোঝাই সোনা

লালন সাঁইজি (১৭৭৪-১৮৯০)
অলীউল আলম
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০
লালন সাঁইজির (১৭৭৪-১৮৯০) বহুমুখী প্রতিভা: গীতিকবি, দার্শনিক, সমাজসচেতন মানবতাবাদী। তিনি কথিত ‘প্রমিত’ সমাজের নন, বরং নিম্নকোটি বর্গের অতি সাধারণ সদস্য। দুর্ভিক্ষপীড়িত, বঞ্চিত-শোষিত হতদরিদ্র কৃষককুলের সন্তান। নদীমাতৃক বাংলার সংবেদনশীলতা ও সহিষ্ণুতা দিয়ে কালীগঙ্গাতীরে সাধন-ভজন আশ্রম গড়ে তুলে মানবতার গান গেয়েছেন। আবার শিষ্যদের নিয়ে শোষকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।
লালন বলেছেন, মানুষের কোনো জাত নেই। মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ নেই। তিনি সমকালীন মোল্লা-পুরোহিতদের ভেদাভেদ সৃষ্টিকারী চিন্তা ও তৎপরতাকে একহাত নিয়ে বলেছেন, ‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/ নারী জাতির কী হয় বিধান/ বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ/ বামুনী চিনি কীসে রে।’
লালনের বিদ্রোহী কিংবা মরমি হওয়ার পেছনে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রভাব অনস্বীকার্য। লালনের শৈশবকালে কূটকৌশলী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন-নির্যাতনে গ্রামীণ সমাজ মহাসংকটে পড়ে। এক মহামন্বন্তর হয়। তখনকার বাংলার তিন কোটি অধিবাসীর এক কোটিই প্রাণ হারায় এতে। এ দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল ইংরেজ বণিকদের কথিত শাসন, লুণ্ঠন এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনায় পতিত গ্রামীণ কৃষকের প্রতিনিধি লালন। আঘাতে আঘাতে শাস্ত্র, আচার, জাতি, ধর্ম সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ লালনের গানে তাই প্রতিবাদ আসে ধর্ম, জাত, কুল, আচার, শাস্ত্রের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। লালন জন্মের ১৫-১৬ বছরের মাথায় ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯) সংঘটিত হয়। এই বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল– স্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্ব অথবা মৃত্যু। একই সময়ে লালন বাংলায় বসে বলছেন– ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’ অথবা বলছেন– ‘সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার/ ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার’, কিংবা ‘কী সন্ধানে যাই সেখানে মনের মানুষ যেখানে।’
বাংলা সাহিত্যের চর্যাপদীয় যুগ লালনকে কতখানি স্পর্শ করেছে, তা সাহিত্য দর্শনের গবেষণার বিষয়। অন্যদিকে মধ্যযুগে যেখানে হাতেগোনা ক’খানা মঙ্গলকাব্য– চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল ও মনসামঙ্গল আর বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে জীবনের সুদীর্ঘ ৯০ বছর পার করেছেন লালন সাঁইজি।
গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস (৪৬৯-৩৯৯ বি.সি.) বলেছেন, ‘নিজেকে জানো’। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার অজ-পল্লিতে বসে সক্রেটিস সম্পর্কে হয়তো লালনের সম্যক ধারণা ছিল না। কিন্তু দুই মনীষীর চিন্তার কী ঐক্য, তা লালনের গানেই আমরা অনুভব করি। লালন বলেন, ‘আত্মতত্ত্ব যেই জেনেছে-দিব্যজ্ঞানী সেই হয়েছে।’ অভিন্ন দার্শনিক চিন্তার ধারক দু’জনেই বিপ্লবী এবং মানবতাবাদী। সক্রেটিস সারা দুনিয়াতে নন্দিত ও সমাদৃত। অন্যদিকে আড়াইশ বছর আগে জন্ম নেওয়া লালন নিভৃতেই ভজন, সাধন ও সিদ্ধিলাভ করেছেন।
গবেষকদের মতে, লালন ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। এ তথ্যও আমাদের অজানা থাকত, যদি তাঁর মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পর মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরী (১৮৯০) পত্রিকায় মৃত্যুসংবাদটি প্রকাশ না হতো।
লালন সাঁই গেয়েছেন ‘আপন ঘরে বোঝাই সোনা/ পরে করে লেনাদেনা/ আমি হলাম জনম-কানা, না পাই দেখিতে।’ আমরা জনম-কানা বলেই লালন সাঁইয়ের মতো প্রতিভাকে চিনতে পারিনি। প্রফেসর ড. অলীউল আলম: উপাধ্যক্ষ, নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ, রাজশাহী
- বিষয় :
- স্মরণ
- আপন ঘরে বোঝাই সোনা
- অলীউল আলম