ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩

সালিমুল হকের জল ও বায়ু

শ্রদ্ধাঞ্জলি

সালিমুল হকের জল ও বায়ু

(২ অক্টোবর ১৯৫২ - ২৮ অক্টোবর ২০২৩)

শেখ রোকন

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৩ | ২৩:৩৪ | আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৩ | ১৩:৪৮

ধর্মগ্রন্থ বলে, পৃথিবীতে প্রাণময় যা কিছু– সবই সৃষ্টি হয়েছে জল থেকে। আর সুফিবাদে আত্মাকে বায়ুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। যে কারণে বাংলা ভাষায় ‘প্রাণবায়ু’ শব্দবন্ধটি প্রচলিত। আমরা দেখি, সালিমুল হকের অস্তিত্বের সঙ্গে মিলে ছিল জল ও বায়ু। ২৮ অক্টোবর (২০২৩) রাতে ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগ পর্যন্তও তিনি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তৎপর ছিলেন। ওই দিন বিকেল ৫টায়ও ফেসবুকে সর্বশেষ পোস্ট করেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার বহুল আলোচিত ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ নিয়ে।

সালিমুল হকের মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়লে বাস্তবের জগতের মতো সামাজিক মাধ্যমেও যে শোকের ছায়া নেমে আসে, সেখানে তাঁকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু সর্বাত্মক মন্তব্যটি করেছেন শিক্ষক ও গবেষক মোহাম্মদ আবদুল বাতেন– ‘জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করেন কিন্তু জনাব সালিমুল হককে চেনেন না– সম্ভবত এমন কোনো মানুষ বিশ্বে নেই।’ বাস্তবিকই গত তিন দশকে সালিমুল হক ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি যেন ‘আইডেন্টিক্যাল’ হয়ে উঠেছিল। বলা হয়, এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সব জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণের রেকর্ড একমাত্র সালিমুল হকের।

বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ জলবায়ু বিশেষজ্ঞ হিসেবে অতি সম্প্রতি তিনি জাতিসংঘের নবগঠিত বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা বোর্ডের বহিঃস্থ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আইপিসিসি ‘অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট’ তৈরিতে বাংলাদেশের হাতেগোনা যে ক’জন বিশেষজ্ঞ কাজ করেছেন, স্বাভাবিকভাবেই সালিমুল হক তাদের মধ্যে ছিলেন। ২০০৭ সালে আইপিসিসি বিশেষজ্ঞ যে দলটি যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিল, সেখানে তিনিসহ বাংলাদেশের আরও কয়েকজন ছিলেন। তাদের সবাইকে পরে আইপিসিসির পক্ষ থেকে সেই পুরস্কারের স্বীকৃতিপত্র দেওয়া হয়। আরেকজন শীর্ষস্থানীয় জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের বৈঠকখানায় তাঁর প্রাপ্ত স্বীকৃতিপত্রটি আমি দেখেছি।

সালিমুল হকের শেষ জীবনের সক্রিয়তা বা স্বীকৃতি দিয়ে অবশ্য জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় তাঁর পূর্ণাঙ্গ অবদান অনুধাবন করা যাবে না। তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই যখন জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণা সম্পর্কে পরিচিত ছিল না, সেই আশির দশকের মাঝামাঝি তিনি ও ড. আতিক এ রহমান মিলে গড়ে তুলেছিলেন এই বিষয়ে বিশেষায়িত বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিসিএএস। পরে কাজ করেছেন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইআইইডিতে। ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়নবিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষণ প্রতিষ্ঠান আইসিসিসিএডি।

সালিমুল হকের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ২০০৯ সালে; কোপেনহেগেনে ‘কপ১৫’ অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে আগে তাঁর কাছে বিষয়টি বুঝতে গিয়েছিলাম। এরপর নানা সময়ে নানা বিষয়ে কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল সক্রিয়তা ও সম্পৃক্ততা। কেবল সভা-সাক্ষাতে নয়; লেখালেখিতেও। শেষ দিকে ডেইলি স্টারে নিয়মিত লিখতেন মূলত অভিযোজন বিষয়ে। এমন মাসও গেছে, পাঁচটি নিবন্ধ লিখেছেন। সামাজিক মাধ্যমেও ‘হাইপার অ্যাকটিভ’ ছিলেন; সবই জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে।

মনে আছে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় জিসিএ তথা ‘গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপ্টেশন’ উদ্বোধন হয়েছিল। সালিমুল হকও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে আমি খানিকটা সমালোচনামূলক নিবন্ধ লিখেছিলাম (আগ্রহীরা পড়ুন– ‘অভিযোজনের দায় কেবল অভাজনের? সমকাল, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০)। ফেসবুকে শেয়ার দেওয়ার পর ইনবক্সে তিনি নক করে বলেছিলেন, কভিড পরিস্থিতি সহজ হলে সমালোচনাগুলো নিয়ে কথা বলতে চান। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের আর দেখা হয়নি।   

এমন আরও অনেকের সঙ্গে তাঁর আরও অনেক কথা ও কাজ নিশ্চয়ই অসম্পূর্ণ থেকে গেল। তবুও বাংলাদেশে ও বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের পক্ষে সালিমুল হককে ভুলে যাওয়া অসম্ভব। অনাগত দিনগুলোতেও যারা কাজ করবেন, তাদের কাছেও তিনি হয়ে থাকবেন চির প্রাসঙ্গিক।
skrokon@gmail.com

আরও পড়ুন