ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩

শোক

আরিফ, বুকের মধ্যে তোমার কবর

আরিফ, বুকের মধ্যে তোমার কবর

আরিফুল ইসলাম

ফারুক ওয়াসিফ

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৩ | ০৪:২১ | আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৩ | ১৬:১৬

তরুণ সংগঠক, প্রকাশক আরিফুল ইসলামকে (৪২) চিনত হয়তো কয়েকশ মানুষ। কিন্তু মৃত্যুর পর দেখলাম, যার সাথেই মিশেছে ছেলেটা, তার মনেই দাগ রেখে গেছে। ভালোবাসার সেই দাগ এখন ক্রন্দনরেখা হয়ে বইছে। যে মানুষ নিজেকে অনেকে ছড়ায়, তার মৃত্যু তার একার থাকে না–তার সাথে সাথে অনেকেরও ছোট ছোট মৃত্যু ঘটে যায়। কবরে যায় হয়তো একজন, কিন্তু যারা তাকে শুইয়ে আসে মাটির ঘরে, দুই মুঠ মাটি ফেলে বা দূর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তারা কি আগের মতো পূর্ণাঙ্গ থাকে? তাদেরও বুকের ভেতর একটা অদৃশ্য কবর জেগে ওঠে। মনে হয়, বুকের ভেতরের সেই কবরে ঝুরঝুর করে মাটি ঝরছে…ঝরছেই। 

দুই বন্ধু কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিল। মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল আরিফ, আর বন্ধু সৌভিক করিম (৪২) বসে ছিল পেছনে। আরিফ-নীলা আর ছোট্ট পুত্র নক্ষত্রের সংসার ইস্কাটনে। বড় মগবাজারে বাড়ি সৌভিক করিমের। হয়তো সৌভিককে নামিয়ে বাসায় ফিরবে ভেবেছিল। সেখানেই একটা ট্রাক ওদের মোটরসাইকেলের পেছনে ধাক্কা মারে। ওরা পড়ে যায়। ট্রাকটা যদি সেখানেই থেমে যেত তাহলেও হয়তো বাঁচানো যেত দুটি তাজা প্রাণ। কিন্তু এই দেশে কেউ দায় নেয় না, দায় এড়িয়ে পালানোই এখানকার জাতীয় রীতি। ট্রাক ড্রাইভার পালাতে গিয়ে ওদের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয় চাকা। 

তারপরও কেউ আসেনি। আধা ঘণ্টা অমনই পড়ে ছিল। সৌভিকের মৃত্যু হয় সঙ্গে সঙ্গে। আধা ঘণ্টা পরে এক পুলিশ কর্মকর্তার উদ্যোগে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা হয়। হাসপাতালের পথেও আরিফের শরীরে প্রাণ ছিল। যদি সঙ্গে সঙ্গেই নেওয়া যেত! কিন্তু মরার দেশে জীবন জিয়ানো খুবই কঠিন। আরিফ আর সৌভিক, দুই সহযোদ্ধা, 
দুই বন্ধু একসাথে মৃত্যুপথের সহযাত্রী হয়ে গেল। 

শোক কী তা জানার বয়স হয়নি ছোট্ট নক্ষত্রের। কিন্তু তার আকাশটা নক্ষত্রহীন হয়ে গেল। বাবাহীন পৃথিবীতে বড় হবে সে। আরিফ আর নীলার কী সুন্দর এক পরিবার। দু’জনই বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন করত। রেবেকা নীলা গানের দল সমগীতেরও সদস্য। সুন্দর গান গায়। আরিফ ছিল ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি, গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য। প্রকাশনা সংস্থা সংহতি গড়ে তুলছিল। পরে যোগ দেয় ইউপিএল প্রকাশনায়।

সেই ছাত্রকালে দেখেছি, কলেজ ড্রেস পরা একদল সদ্য তরুণ চলে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে। সেই শুরু। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো আরিফ আর কয়েক বন্ধু। সবাই তুখোড়, ধারালো, গভীর। রাজনীতি করার পাশাপাশি কেউ কবিতা লেখে, কেউ গান করে, কেউবা গভীর বিষয়ে পণ্ডিত হওয়ার সাধনায় রত। যেমন সৌভিক করিম উচ্চাঙ্গ সংগীত আর সংগীততত্ত্বের চর্চা ছাড়েনি। পড়াত একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

কাকে দোষ দেব? অবকাঠামো বানাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়, কিন্তু সড়ক হয় আরও অনিরাপদ। সড়ক নিরাপত্তা আইন ক্ষমতাবান নেতার চাপে বদলে যায়। এই দেশে জীবনের বাগান তছনছ হয়, দিনরাত চলে মৃত্যুর কারখানা। গত মঙ্গলবারও চট্টগ্রামে এক পরিবারের সাতজন একসাথে মরে গেল। এসব দুর্ঘটনা নয়, কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। সরকার নাকি জীবন-মৃত্যুর ম্যানেজার। সড়কে মৃত্যুর মিছিলের জন্য সেই ম্যানেজারের দায় নাই?

প্রায়ই শোকের জানাজায় শামিল হচ্ছি আমরা। ক’দিন আগে অকালে মরে গেল কবি ও চলচ্চিত্রনির্মাতা রাজীব আশরাফ। তারপরই খবর এলো কবিবন্ধু তারেক মাহমুদ নাই। আরিফের মৃত্যু তো আরও অবাস্তব, অসম্ভব, অবিশ্বাস্য। আরিফ মানে ভরসা। আরিফ মানে সহজ মানুষ। আরিফ মানে পাশে থাকা ভাই। এরকম তীব্রভাবে জীবন্ত মানুষের এমন অকালমৃত্যু হবে কেন? মরার দেশে জীবন জিয়ে না। আমাদের সম্মিলিত মৃত্যুর পটভূমিতে তরুণদের মৃত্যু একটা হুঁশিয়ারি। দেশটা খুব গভীরে অসুস্থ ও জীবনবিরোধী হয়ে আছে; নইলে অকাতরে এত তরুণের অপঘাত, আত্মহত্যা, অকালমৃত্যু ঘটতে পারত না।

আরিফের মৃত্যুর দুঃখটা একসময় কমে আসবে, কিন্তু এই শোক সহসা ফুরাবার নয়।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
farukwasif0@gmail.com

আরও পড়ুন