ক্ষীয়মাণ ভালোবাসা
অন্যদৃষ্টি
মতামত
প্রীতম দাস
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৩ | ২২:৫২ | আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৩ | ১৯:০০
সন্তানকে সাফল্যমণ্ডিত করার পেছনে মা-বাবার অবদান অতুলনীয়; যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। একজন বাবা তাঁর সন্তানকে মানুষ করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৫-১৬ ঘণ্টা কর্মে ব্যয় করছেন সন্তানের পড়ালেখার খরচ দেবেন বলে। সন্তানের পরীক্ষা দেওয়ার সময় মা সারাদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন, সন্তানের জন্য মঙ্গল কামনা করেন। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ৪৫ ডেল ইউনিট ব্যথা সহ্য করতে পারে কিন্তু সন্তান জন্মদানের সময় একজন মা ৫৭+ ডেল ইউনিট ব্যথা সহ্য করেন, যা স্বাভাবিক মানুষের হার ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ওই সন্তানই প্রতিষ্ঠিত হয়ে মা-বাবার অবদান ভুলে গিয়ে তাদের বোঝা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে।
বর্তমান সমাজে ছেলেমেয়ে যখন নতুন বাসা নির্মাণ করে তখন তাদের বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য থাকে না কোনো নিজস্ব কক্ষ। বাসায় তাদের জন্য থাকে না কোনো নিজস্ব জায়গা। বৃদ্ধাশ্রমের চাহিদাও সেজন্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশ সারাদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘোরাঘুরি, আড্ডা দেওয়া– এসব নিয়ে পড়ে থাকে। তার মা-বাবা দিনে তিন বেলার জায়গায় এক বেলা খাবার খেয়ে টাকা পাঠাচ্ছে ছেলেমেয়ের কাছে, তার ছেলেমেয়ে যেন মানুষের মতো মানুষ হয়।
২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর জাতীয় সংসদে ‘পিতা-মাতা ভরণপোষণ বিল-২০১৩’ পাস হয়েছিল। ওই বিলে বলা হয়েছিল, প্রত্যেক সন্তানকে বাবা-মার সঙ্গে একই স্থানে বসবাস করতে হবে। কোনো সন্তান তার বাবা বা মাকে বা উভয়কে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৃদ্ধনিবাস বা অন্য কোথাও বা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। প্রত্যেক সন্তানকে তার বাবা-মার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে। তারা পৃথকভাবে বসবাস করলে সন্তানদের নিয়মিত সাক্ষাৎ করতে হবে। এ-সংক্রান্ত অপরাধের জন্য এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেলের বিধান রাখা হয়েছে।
অর্থাৎ এ বিল থেকেই প্রমাণিত যে, বর্তমান সমাজ কতটা অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে। একজন সন্তান তার মা-বাবাকে সেবা-শুশ্রূষা করবে, আর তার জন্য সংসদে বিল পাস করা লাগে! মা-বাবা ও গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, কর্তব্যবোধ আইন/বিল পাস করিয়ে আর জোর করে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন নৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন। আমাদের মধ্যে যদি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিজে থেকে জাগ্রত না হয়, তাহলে জোর করে বা আইন পাস করে তা সম্ভব নয়।
বর্তমান সমাজে অনেকের বছরের মধ্যে এক দিনও ঠিকমতো মা-বাবার সঙ্গে সরাসরি মন খুলে কথা বলার সময় থাকে না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মা-বাবার সঙ্গে ছবি আপলোড দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। সেই সন্তানই বাবা-মা দিবস এলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দেয়। বাবা-মা কিন্তু জানে না কোন দিন বাবা দিবস, কোন দিন মা দিবস। বাবা-মাকে ভালোবাসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিবস বা দিনের প্রয়োজন হয় না। যে সন্তান বাবা-মাকে নিজের বোঝা মনে করে, বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে, হয়তো তার ছেলেমেয়েও একদিন তার সঙ্গে একই কাজ করবে অর্থাৎ বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে।
বাবা-মা কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ বানাবে আর সেই সন্তানই প্রতিষ্ঠিত হয়ে মা-বাবাকে সুখ-শান্তি দেওয়ার ফলে রেখে আসে ওই বৃদ্ধাশ্রম নামের একটা কুটিরে। যে সময় বৃদ্ধ বাবা-মা তাদের নাতি-নাতনিদের সঙ্গে গল্প করে, খেলাধুলা করে সময় কাটানোর কথা, ওই সময় তারা থাকেন একা একা ছোট্ট কুটিরে, জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে। নিকৃষ্ট প্রহর যেন কাটে না, সেই কথা ভাবতে ভাবতে অশ্রুসিক্ত নয়ন থেকেও আর অশ্রু পড়ে না।
প্রীতম দাস: শিক্ষার্থী