দু্ই বিচারকের স্মৃতি ও শান্তির স্বপ্ন
স্মরণ
বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল আহমেদ
মহসিনুল হক
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৩ | ২২:১০
দু’জন সিনিয়র সহকারী জজ জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল আহমেদ ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর উগ্র জঙ্গিবাদী বোমা হামলায় নিহত হন। প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর এলে বিচার বিভাগ গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে এ দু’জন বিচারককে।
বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল আহমেদ যে সময় নিহত হয়েছিলেন, সে সময় বাংলা ভাইসহ জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে এক ভয়াবহ অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল। আমরা দেখেছিলাম ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা। এর আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সংঘটিত হয়েছিল গ্রেনেড হামলা।
আমাদের নতুন প্রজন্ম এখন এদের বিরুদ্ধে। এই প্রজন্ম এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে, যেখানে কোনো ধর্মবিদ্বেষ থাকবে না; বর্ণ বা সম্প্রদায় বা দল মানুষের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে না। সেখানে সবাই বিশ্বাস করবে– আমরা একই জাতি। তাদের কেউ হবে কৃষক, কেউ শ্রমিক, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী। একটি খেলার দলে একেক খেলোয়াড় একেক ভূমিকা পালন করলেও সবার লক্ষ্য থাকে টিমকে জেতানো। তেমনি সমাজের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষের কাজ ভিন্ন হলেও জীবনের লক্ষ্য হবে অভিন্ন– একটি বাসযোগ্য, শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ।
আমরা চাই বাংলাদেশের তরুণদের একদিকে থাকবে বিশ্বাস, আরেকদিকে থাকবে যুক্তি ও বিবেক। ধর্মের জিগির তুলে মুক্তচিন্তা বা বিশ্বাসকে ভুল পথে প্রবাহিত করে স্বার্থোদ্ধারে দেশ-জাতির জন্য ক্ষতিকর কাজে তাদের কেউ ব্যবহার করতে পারবে না।
ধর্ম হবে এক আলোকবর্তিকা। সমাজে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় মানুষকে উজ্জীবিত করে তোলার মূলমন্ত্র হবে এই ধর্ম। সবার ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবন হবে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সংস্কার ও আদর্শ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। সেখানে কেউ কারও বিশ্বাসের প্রতি অবজ্ঞা হেতু কুৎসিত আক্রমণ করবে না।
এই প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে, আগামীর বাংলাদেশ হবে মানবতার কল্যাণে নিবেদিত একটি দেশ। এই বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে থাকবে গভীর দেশপ্রেম। তারা হবে এই দেশ ও জাতির সম্পদের রক্ষক, সৎ ও আদর্শ নাগরিক। সেই বাংলাদেশে শুধু শাস্তির ভয়ে নয়, বরং আত্মার তাগিদেই মানুষ যাবতীয় অপরাধ থেকে নিবৃত্ত থাকবে। প্রতিটি জীবন ও সম্পদের থাকবে পূর্ণ নিরাপত্তা। এ দেশে নারীকে কেউ কখনও অসম্মান করার কথা কল্পনাতেও ভাববে না। স্কুলফেরত ছোট্ট শিশুটি সড়ক কিংবা ফুটপাত ধরে নিশ্চিন্তে পথ হেঁটে পৌঁছে যাবে নিজ বাড়িতে।
এই প্রজন্ম এখন মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে, জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী ও তাদের সমর্থকরা হিংসা ও নিপীড়নের মাধ্যমে যে সমাজ গড়ে তুলতে চায়, সেখানে আমাদের মানবিক বোধ বিপন্ন হতে বাধ্য। বিচারক জগন্নাথ-সোহেলের মৃত্যু দিবসে এই প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হয়ে স্পষ্ট বলতে চাই– আমরা বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী, প্রগতিশীল, সুকুমারবৃত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আমরা চাই বাংলাদেশ হবে সারাবিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের চিন্তা-চর্চার প্রাণকেন্দ্র। আগামীর বাংলাদেশ হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আলোকিত বাংলাদেশ।
তবে জঙ্গিবাদীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমাজ গড়ে তোলার কাজটি সহজ নয়। এ জন্য আমাদের আরও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে। আমরা যখন আত্মত্যাগ করতে শিখেছি; যখন আমাদের রয়েছে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের স্রোতধারা; যখন আমাদের সামনে রয়েছে জগন্নাথ-সোহেলের রক্তের ঋণ, তখন আমাদের এই প্রজন্মকে কেউ বিপথে নিয়ে যেতে পারবে না। আমরা এসব শহীদের রক্ত বৃথা
যেতে দিতে পারি না। মেনে নিতে পারি না পরাজয়।
মহসিনুল হক: সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, চাঁদপুর