ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

বাংলাদেশ কি পরাশক্তিগুলোর স্নায়ুযুদ্ধে পড়ে যাবে?

ভূরাজনীতি

বাংলাদেশ কি পরাশক্তিগুলোর স্নায়ুযুদ্ধে পড়ে যাবে?

.

এম এ আজিজ

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:২৩

বিশ্বের মূলত চার পরাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধের ভরকেন্দ্র হতে পারে বাংলাদেশ, যদি রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপের মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে না পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ১৩ নভেম্বর বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এবং পরে আওয়ামী লীগকে শর্তহীনভাবে সংলাপ করে সমঝোতার মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করতে চিঠি দিয়েছেন। এটাই হয়তো হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংকট নিরসনের শেষ পদক্ষেপ।
চিঠিতে মূলত তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন দেখতে চায়। দ্বিতীয়ত, শর্তহীনভাবে সংলাপের কথা বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসা নীতি গ্রহণ করেছে, তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ৭ জানুয়ারি ২০২৪ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের তারিখ ধার্য করে তপশিল ঘোষণা করেছেন। নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংকট বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ করার সুযোগ রেখে সিইসি আরও অন্তত ১৫-২০ দিন পর ভোটের তারিখ রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এতে সরকারি দলকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে বাইরে রেখে অতিদ্রুত নির্বাচন করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির কেন্দ্র থেকে গ্রাম পর্যায় কমবেশি ১০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে দলটিকে নেতৃত্বশূন্য এবং নির্বাচনে সংসদ সদস্য প্রার্থীশূন্য করার প্রচেষ্টা চলমান। বিরোধী দলগুলো এই তপশিল প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বিরতি দিয়ে হরতাল-অবরোধ ডাকছে। ১৯ নভেম্বর ভোর ৬টা থেকে আবারও তারা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল চলমান।

যাহোক, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বড় ধরনের বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রবাসী আয়সহ অনেক ধরনের সম্পর্কের পাশাপাশি ‘নিরাপত্তা সহযোগিতা’ আছে, যা মার্কিন জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব মিত্র রাষ্ট্রের সঙ্গেও বাংলাদেশের অনেক ধরনের সম্পর্ক আছে। এ ছাড়া রয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে ভূরাজনীতি।

ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং আরও ভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসার আশঙ্কার অন্তর্নিহিত কারণ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, পরাশক্তিগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন, মধ্যে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতার ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ঘোষণা করে। সেখানে দেখানো হয়েছে, এ অঞ্চলের ভূমি বিশ্বের ২৫ শতাংশ ও সমুদ্রের ৬৫ শতাংশ। এ অঞ্চলের দেশগুলোর জনসংখ্যা বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি, যার ৫৮ শতাংশই তরুণ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক অর্থনীতির দুই-তৃতীয়াংশ, জিডিপি ৬০ শতাংশ ও ভোক্তা ৬০ শতাংশ।

এই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন, ভারত, পাকিস্তান, জাপান, কোরিয়াসহ এক ডজনেরও বেশি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ আছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, সব মিলিয়ে এ অঞ্চল হয়ে উঠছে বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু এবং আগ্রহের কারণ। অন্যদিকে, পরাশক্তিগুলো তাদের আধিপত্য বিস্তার ও নিজেদের জন্য অর্থ-সম্পদ খুঁজতে একে অপরের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত। যেমন– মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম নিয়ে আসা রুশ জাহাজ অনুমতি না পেয়ে পণ্য খালাস না করেই ভারতীয় জলসীমা থেকে ফিরে যায়। ব্রিকস সম্মেলনের সাইডলাইনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। বৈঠকের পরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে স্বপ্নের দেশ বানিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

২০২১ সালে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘কোয়াড’ নামের ‘বেইজিংবিরোধী ক্লাবে’ যোগ না দেয় এবং এটি করলে চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মারাত্মক ক্ষতি হবে। এদিকে, ৫০ বছর পর বন্ধুত্বপূর্ণ সফরে রাশিয়ার দুটি সাবমেরিন বিধ্বংসী যুদ্ধজাহাজ এবং একটি জ্বালানিবাহী ট্যাংকার চট্টগ্রাম বন্দর ঘুরে গেছে। 

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া, চীন ও ভারত এই নির্বাচনকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে পরক্ষভাবে বাংলাদেশের সরকারের অধীনে নির্বাচনকে সমর্থন করছে।
অন্যদিকে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচনের পর বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাপানসহ পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, সহিংসতামুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। সেই সঙ্গে এ দেশগুলো মনে করে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার করে।

এদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ মনে করে, জনগণ অর্থাৎ ভোটাররা অংশগ্রহণ করলেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যে নির্বাচনে সর্বোচ্চসংখ্যক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে; যে রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক ভোটার রয়েছে ও তাদের মধ্য থেকে যদি কোনো রাজনৈতিক দলের জয়ের সম্ভাবনা থাকে এবং সেই দলগুলো যদি স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, তাহলেই তাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে।

অন্যদিকে, দেশের অর্থনীতির সব সূচকই নিম্নমুখী। পাশাপাশি কয়েকজন স্বজনতোষী অলিগার্কের হাতে পুঞ্জীভূত অর্থ-সম্পদ, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, সর্বোচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি ও চরম আয়-বৈষম্য দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে। বিশেষ করে বর্তমানে ডলার সংকট এবং আয়-বৈষম্য দেশকে চরম ঝুঁকিতে ফেলেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ১৯ বিলিয়ন ডলার। এমনকি ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো নতুন এলসি খুলতে এবং আগের দেনা পরিশোধ করতে পারছে না। আয়-বৈষম্য সর্বকালের সর্বোচ্চ। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ আয়-বৈষম্যের শিকার। বর্তমানে ১০ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ।

বর্তমান রাজনীতি ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা, হরতাল-অবরোধ এবং সম্ভাব্য বিদেশিদের কঠোর চাপ যদি আরও ঘনীভূত বা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সব মিলিয়ে দেশের এই ভঙ্গুর অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।

এম এ আজিজ: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন

×