ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩

অন্যদৃষ্টি

বার্ধক্যে হাতের লাঠি

বার্ধক্যে হাতের লাঠি

প্রতীকী ছবি

শাহিন সপ্তম

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৩ | ২১:৫৬ | আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৩ | ১৫:৪০

ট্রাক্টরে চাপা পড়া বা বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া গেলেও ‘বার্ধক্যে’ মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলা যায় না। মানুষের সব মনোবল ভেঙে পড়ে বার্ধক্যে। এ সময় যারা বাড়তি মনোযোগ পায়, তারাই বার্ধক্যকে উপভোগ করে। যারা দারিদ্র্যজর্জর, অর্থ উপার্জনের সুযোগহীন, পরিবার-পরিজনের সুদৃষ্টিবঞ্চিত, তাদের কাছে বার্ধক্য এক প্রকার নরকযন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ দেশে ৬০ থেকে ১০০ বা তদূর্ধ্ব বয়সের নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১৩ হাজার।

জনসংখ্যার এই অংশের মানুষ কেউ অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী অথবা চাকরিজীবী, কেউ শ্রমজীবী, কেউবা কর্মহীন। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর অসহায় অংশের নরকযন্ত্রণা কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭-৯৮ সালে চালু করেছিলেন বয়স্ক ভাতা। তখন প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫ জন নারী ও ৫ জন পুরুষ মিলিয়ে মাত্র ১০ জনকে দেওয়া হতো মাসে ১০০ টাকা। মোট এই সুবিধা পেত ৪ দশমিক শূন্য ৩ লাখ বয়োবৃদ্ধ নারী-পুরুষ। বর্তমানে এ সংখ্যা ৫৮ লাখ ১ হাজার। মাথাপিছু প্রদেয় টাকার পরিমাণ ৬০০। 

টাকার পরিমাণ এখনও সামান্য, সন্দেহ নেই। তবে এই সামান্য অর্থের শক্তি অনুধাবনে একটি গল্প সাজানো যাক: বৃদ্ধ কাওসার। বয়স ৬৭ বছর। স্ত্রী মারা গেছেন। তিন ছেলে আর দুই মেয়ে। সবাই বিবাহিত। যৌবনকালে দিনমজুরি করে সংসার চালিয়েছেন; সন্তানদের হাওয়ায় মিঠাই, লজেন্সের মতো ছোটখাটো চাহিদা পূরণ করেছেন। কিন্তু আজ এই বয়সে একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কল্পনা করছেন– আহ! যদি একখান পাউরুটি খাওয়া যেত! তাঁর সে কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেবে কে? যে সন্তানদের জন্য রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের মধ্যে পরিশ্রম করেছেন, সেই সন্তানরা এখন তাদের সন্তান নিয়ে ব্যস্ত! সন্তানদের এই ব্যস্ততা অস্বীকার করা যায় না। তাহলে বৃদ্ধ পিতার কী হবে? এই বয়সে তিনি কি দোকানের সামনে সামান্য পাউরুটির কল্পনা করে জিহ্বার ডগায় আসা জল পান করতে করতে অন্তিম শয্যার অপেক্ষায় দিন কাটিয়ে দেবেন? 

এই নিদারুণ চিত্র বদলাতেই হয়তো বয়স্ক ভাতার প্রচলন ঘটেছে। এখন ওই বৃদ্ধ কাওসার দোকানে সাহস নিয়ে যেতে পারেন। এটিও এক প্রকার স্বাধীনতা; ইচ্ছা পূরণের স্বাধীনতা। সরকারি এ পদক্ষেপ আপাতদৃষ্টিতে সমাজের বৃহৎ পরিবর্তন না ঘটালেও অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো সমাজের মধ্যে এমন এক বিন্যাস তৈরি করে যাচ্ছে, যেখানে দরিদ্র পরিবারে পিতা ও সন্তানের মধ্যকার কদর্য রূপের প্রদর্শনীর পরিবর্তে বেঁচে থাকার আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিস্ময়কর বিষয় হলো, বাংলাদেশে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা বিশ্বের ২৩৪টি দেশের মধ্যে ১১৮টি দেশের জনসংখ্যার সমান। এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সাহসী এবং কল্যাণ রাষ্ট্র ধারণা প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ বলে মনে করি।

এটি একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কের অনন্য উদ্ভাবন। কারণ তিনি শুধু দারিদ্র্যক্লিষ্ট পিতা-মাতার কথা ভাবেননি; এই ভাবনার সঙ্গে যুক্ত করেছেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির পিতামাতাকে, যাদের তিনি পেনশন সুবিধার আওতায় নিয়ে আসতে চান।

ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ড্যামিয়েন গ্রিন বলেছিলেন, ‘একটা নির্দিষ্ট বয়সে আমরা সবাই রাষ্ট্রীয় পেনশনের সুবিধা পাওয়ার অধিকারী। তবে সর্বোপরি সবাইকে আমরা যা করতে উৎসাহ দিই তা হলো– বৃদ্ধ বয়সে স্বাচ্ছন্দ্য পেতে নিজে কিছু সঞ্চয় করুন।’

আর্থিক বৈষম্য কমিয়ে বাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়ানোর এই সৃজনশীল উদ্যোগ আমাদের সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেঁচে থাকার স্বপ্নকে সজীব করে যাচ্ছে। তবে এখানেই থামলে চলবে না; বার্ধক্যে হাতের লাঠি হিসেবে বয়স্ক ভাতার পরিমাণ ও পরিধি আরও বাড়াতে হবে।

শাহিন সপ্তম: কবি ও প্রাবন্ধিক
shaptam7@gmail.com

আরও পড়ুন