ঢাকা সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪

সামাজিক মাধ্যম

তথ্য বিশৃঙ্খলার তেজি ঘোড়া রুখবে কে?

তথ্য বিশৃঙ্খলার তেজি ঘোড়া রুখবে কে?

মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী

মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:২৩ | আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৩ | ১২:৪২

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, সামাজিক মাধ্যমগুলোতে নির্বাচন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘিরে তত বেশি ভুয়া, মিথ্যা ও অপতথ্যের বিস্তার ঘটছে। ইতোমধ্যে সমকালসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে খবর পরিবেশন করেছে। গত এক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে মিথ্যা ও অপতথ্যের ছড়াছড়ি; নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং ভোটার, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের ওপর এসবের প্রভাব পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশেও আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। উপরন্তু বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, নির্বাচন ঘিরে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের ব্যাপক প্রচার দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে শুধু রাজনৈতিকভাবে বিভাজিতই করে না, বরং তাদের মধ্যে ধর্ম ও জাতিগত বিদ্বেষের এমন বিষ তৈরি করে, যা থেকে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আশঙ্কার বিষয়, আসন্ন নির্বাচনে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ভুল, মিথ্যা, অপতথ্য ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার রোধে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই। 

ইউনেস্কোর মতে, আমরা এখন এক ‘ভুল তথ্যযুদ্ধের (ডিজইনফরমেশন ওয়ার) জগতে’ বাস করছি, যেখানে শুধু সামাজিক মাধ্যমগুলো নয়, বরং মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও ভুল, মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়িয়ে পড়ছে। এখন সম্মিলিতভাবে মিথ্যা ও অপতথ্যকে তুলে ধরতে গিয়ে ‘তথ্য বিশৃঙ্খলা (ইনফরমেশন ডিজঅর্ডার)’ শব্দবন্ধ পরিচিতি পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই তথ্য বিশৃঙ্খলার সবচেয়ে বড় শিকার হলো তরুণ সমাজ। কারণ এই গোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি এবং তাদের মধ্যে ভুয়া, মিথ্যা ও অপতথ্য কিংবা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দিয়ে বিভেদ ও সংঘাত তৈরি করা যায়।  

বিশ্বব্যাপীই কর্তৃপক্ষ ও রাজনীতিবিদরা সামাজিক মাধ্যমকে প্রচার ও নাগরিক সম্পৃক্ততার সরঞ্জাম হিসেবে যত বেশি গ্রহণ করছে, অনলাইন জগতে তত অতিরঞ্জিত ও অপতথ্যের প্রসার ঘটছে। যুক্তরাজ্যের ‘ডিজিটাল, কালচার, মিডিয়া অ্যান্ড স্পোর্টস’বিষয়ক সংসদীয় কমিটির (ডিসিএমএ) প্রতিবেদনে এমন কথাই বলা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মানুষের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ও ভীতি উস্কে দিয়ে নির্বাচনে ভোট ভাগিয়ে নিতে সামাজিক মাধ্যমে ‘ভুয়া খবর’ ছড়ানোর বিষয়টি গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করেছে। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক সংঘাতপূর্ণ দেশের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি অনেক বেশি। এর পেছনে তিনটি বিষয় কাজ করছে। প্রথমত, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে তরুণ ভোটার সংখ্যার আধিক্য; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা; এবং তৃতীয়ত, আসন্ন নির্বাচন ঘিরে ইতোমধ্যে ইনফরমেশন ডিজঅর্ডারের বিস্তৃতি, যা তরুণ ভোটারদের মধ্যে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দিয়ে বিভেদ ও অবিশ্বাস তৈরি করছে।  

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবার ভোট দেবে প্রায় দেড় কোটি ভোটার, যা গত সংসদ নির্বাচনের চেয়ে দেড় গুণ। এই নতুন ভোটারের বেশির ভাগই তরুণ। অন্যদিকে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় সবাই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে। মেটার তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ফেসবুকের দৈনিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির শীর্ষ তিন দেশ হলো ভারত, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশ। উল্লেখযোগ্য বিষয়, অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের মতো বাংলাদেশের বেশির ভাগ ফেসবুক ব্যবহারকারীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। এই বয়সী ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দুই কোটিরও বেশি।

বাংলাদেশের মতো মিশ্র সংস্কৃতির দেশে, যেখানে ধর্ম ও রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে বিভাজন ঐতিহাসিকভাবে বিদ্যমান, সেখানে ডিজিটাল পরিসরে এসব মাধ্যমে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং ভুল ও অপতথ্য ছড়িয়ে পড়তে আমরা দেখেছি, যা তরুণ সমাজের মধ্যে সম্প্রীতি বিনষ্টের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্বেগজনক। গত ২৩ আগস্ট দৈনিক সমকালে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, গুজব ও মিথ্যা তথ্য প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা তৈরি করে এবং ছড়ায়। ভোটের বছরে অনলাইন তৎপরতা ও অপতৎরতা দুই-ই বাড়ছে। 

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের ২০২০ সালে পরিচালিত বিশ্বের ৮১টি দেশকে নিয়ে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৬টি দেশে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে মিথ্যা তথ্য ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানো হয়। সেটা এখন পেশাদাররা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে করে। নির্বাচন ও রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ ‘সাইবার আর্মি’ বা ট্রল বাহিনী গঠন ও বটের (রোবটের সংক্ষিপ্ত রূপ) মাধ্যমে ভুয়া খবর ও বিদ্বেষমূলক বার্তাগুলোকে ভাইরাল করা হচ্ছে। বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। 

নির্বাচনে সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া খবরের ছড়াছড়ির প্রভাব নিয়ে আমাদের নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো ওয়াকিবহাল থাকলেও এখনও দৃশ্যত কার্যকরী পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের শুধু মেটা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি বৈঠকের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। মেটা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নির্বাচন কমিশন থেকে ভুয়া, মিথ্যা তথ্য ও বিদ্বেষপূর্ণ পোস্ট সম্পর্কে অভিযোগ জানালে সেটি তারা সরিয়ে নেবে। এ ধরনের আশ্বাস অতীতে অনেক দেশে কাজ করেনি। ২০২২ সালে মালয়েশিয়ার নির্বাচনের সময় টিকটকে প্রচুর রাজনৈতিক ও জাতিগত বিদ্বেষমূলক ভিডিও ছড়িয়ে পড়লেও টিকটক কর্তৃপক্ষের কোনো কার্যকর হস্তক্ষেপ ছিল না। 

সামাজিক মাধ্যমগুলোর কর্তৃপক্ষ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার কথা বলে। কিন্তু মিথ্যা ও অপতথ্য এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচারের মাধ্যমে নির্বাচনের সময় যাতে উত্তেজনা ও সহিংসতা ছড়াতে না পারে, তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। বাংলাদেশের নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো রোধে সামাজিক মাধ্যমগুলো কনটেন্ট মডারেশন ব্যবস্থা আরও উন্নত করা দরকার। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ ডেটা সেট দিয়ে তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমকে শক্তিশালী করা দরকার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও অপতথ্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর উচিত স্থানীয় বিশেষজ্ঞ, এনজিও এবং শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্র প্রসারিত করা। পাশাপাশি দেশীয় সংবাদমাধ্যম সম্মিলিতভাবে এ ধরনের ভুয়া ও অপতথ্যের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে নির্বাচনের আগে সংবাদমাধ্যমগুলো সম্মিলিতভাবে তথ্য বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে লড়ে সুফল পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ব্রাজিলের ‘কমপ্রোভা’, মেক্সিকো ও উরুগুয়ের ‘ভেরিফিকাডো’র কথা বলা যায়।

তথ্য বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে লড়তে হলে তরুণদের লক্ষ্য করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচি ও প্রকল্প হাতে নিতে হবে। ইতোমধ্যে দেশি-বিদেশি কিছু প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশৃঙ্খলা নিয়ে তরুণদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচিতে সাময়িকভাবে বেশ ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। যেমন- সম্প্রতি জার্মানির ডিডব্লিউ একাডেমির একটি প্রকল্পের অধীনে দেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচশত শিক্ষার্থীর মধ্যে তথ্য বিশৃঙ্খলা ও অনলাইনে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়া প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির একটি কর্মসূচি শেষে দেখা গেছে, মূলত অজ্ঞতার কারণেই যে তরুণরা অনলাইনে অপতথ্য ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দেয় সে উপলব্ধি তাদের মধ্যে এসেছে। 

ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নয় শুধু; জাতীয় সম্প্রীতি ও নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এটি কেবল ভোটারদের মেরূকরণ করতেই সক্ষম নয়; পাশাপাশি সহিংসতাও উস্কে দিতে পারে। এখনই এ বিষয়ে মনোযোগ না দিলে সামনের জাতীয় নির্বাচনে বিষয়টি জাতীয় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। কারণ মিথ্যা তথ্যের ঘোড়া সত্য তথ্যের ঘোড়ার চেয়ে অনেক বেশি তেজি হয়। 

মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×