আন্তর্জাতিক
ভালোর জন্যই হামাস বিষয়ে একটু ভেবেচিন্তে চলুন
.
এম কে ভদ্রকুমার
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২২:৪৮
তাদের আপনি কীট বলতে পারেন বা ফেরিওয়ালা বলতে পারেন অথবা সরাসরি প্রভুর নির্দেশে ঘেউ ঘেউ করা কুকুরের সঙ্গেও তুলনা করতে পারেন; ইসরায়েলি কূটনীতিকরা দিনে দিনে আন্তর্জাতিক পরিসরে একটা অনন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছেন; তা হলো, তেল আবিব যখন তাদের স্বাগতিক দেশের ঘাড়ের রগটি আবিষ্কারের নির্দেশ দেয় তখন সেটি বাস্তবায়নে তাদের তর সয় না– এমনকি এ জন্য কূটনৈতিক শিষ্টাচার বা ঔচিত্যবোধও জলাঞ্জলি দিতে তারা কসুর করেন না।
যিনি তাদের এটি শিখিয়েছেন তিনি আর কেউ নন, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এভাবেই তিনি ২০১৫ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওবামার যথাযথ চ্যানেল এড়িয়ে কয়েকজন মার্কিন আইনপ্রণেতাকে ব্যবহার করে তাঁর ওয়াশিংটন সফরের ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন কংগ্রেসের একটি যৌথ অধিবেশনে তিনি ভাষণও দিয়েছিলেন। এটি তিনি করেছিলেন পারমাণবিক চুক্তি ঘিরে তেহরানের সঙ্গে ওবামার আলোচনা ভণ্ডুল করার চেষ্টা হিসেবে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি স্পষ্ট হস্তক্ষেপ ছিল। এর মাধ্যমে নেতানিয়াহু কেবল ওবামাকে ছোট করেননি, বরং দেখিয়েছিলেন যে ওয়াশিংটনে ক্ষমতার কলকাঠি যারা নাড়েন তাদের ওপর তাঁর প্রভাব প্রেসিডেন্টের চেয়েও বেশি ছিল। এর মাধ্যমে নেতানিয়াহু ইরানের প্রতি মার্কিন নীতি নির্ধারণে হোয়াইট হাউসকেও নির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি জানতেন এমন অপকর্মের পরও তিনি পার পেয়ে যাবেন, কারণ মার্কিন রাজনীতির প্রভাবশালীদের মধ্যে অনেকেই ইসরায়েল লবির কাছে থেকে নিয়মিত টাকা পেতেন।
এ ঘটনা মনে পড়ল সংবাদমাধ্যমে নয়াদিল্লিতে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত নাওর গিলনের হামাস সম্পর্কিত একটি মন্তব্য দেখে, যেখানে তিনি প্রকাশ্যে হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে ফিলিস্তিনের প্রতি ভারতীয় নীতি পরিবর্তনের দাবি করেছেন। গিলন প্রায় ৩৫ বছর ধরে কূটনীতিতে আছেন এবং তিনি তাঁর অধিকারের সীমা সম্পর্কে অজ্ঞ এমনটা মনে করার অবকাশ নেই। ধারণা করা হয়, দিল্লি তাঁর এ রাজনৈতিক তৎপরতায় বাধা দিয়েছে, তাই তিনি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ইসরায়েল লবিকে ব্যবহার করেছেন।
সময়টা এখন এমন, যখন গাজায় তার বর্বর নিষ্ঠুরতার কারণে দেশটির খ্যাতি কাদায় ডুবে আছে। তাই ইসরায়েলি কূটনীতি একটি সাফল্যের গল্প পেতে মরিয়া হয়ে আছে। ইসরায়েল যে গণহত্যা করছে এবং জাতিগত নির্মূলের কাজ করছে, এ ধারণা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। আমেরিকান চাপে ইসরায়েলের মত পরিবর্তন না হলে, যার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না, হামাসের সঙ্গে সে একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে যাচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমা চাপের অভাব রয়েছে। মঙ্গলবার দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে জি৭ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা তাদের বক্তব্য ‘মানবিক সহায়তার পরিমাণ বাড়াতে এবং সব জিম্মির মুক্তির সুবিধার্থে প্রয়োজন অনুসারে যুদ্ধবিরতির আরও সম্প্রসারণে’ সাহায্যদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন।
বিবৃতিতে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়নি, তবে জি৭-এর ওই বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ইসরায়েলের নিজেকে এবং তার জনগণকে রক্ষা করার অধিকার আছে। কারণ সে ৭ অক্টোবরের হামলার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে চায়।’
খুব বাহাদুরি দেখানো সত্ত্বেও, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এখন পর্যন্ত নিজের সাফল্যের কোনো খতিয়ান দেয়নি; তারপরও সে এ নিয়ে বেশ লাফালাফি করছে। কিন্তু এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, যেহেতু গাজায় হামাসের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। অতএব, সামনে ভয়াবহ সহিংসতার সময় রয়েছে। হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরবর্তী ধাপগুলোয় ইসরায়েল তার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন যেসব দেশকে পাশে পেতে তৎপরতা চালাচ্ছে, ভারত সেগুলোর একটি।
যে কোনো জায়গায় প্রতিরোধ আন্দোলনের ভয়ানক সৌন্দর্য হলো, তারা কখনোই মারা যায় না। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে হামাস ফিলিস্তিনের যে কোনো ভবিষ্যতে সুস্পষ্ট জায়গা পাবে, যেমনটা পেয়েছে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)। এএনসি ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত একটি নিষিদ্ধ সংগঠন ছিল, কিন্তু বর্ণবাদ-পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকায় সেই শেষ কথা বলছে।
পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার ওপর ইসরায়েল সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং নিজেকে চালাক প্রমাণ করতে গিলন দাবি করেছেন, ভারতের উচিত হামাসকে নিষিদ্ধ করে এর প্রতিদান দেওয়া। যদিও তাঁর তুলনাটি হাস্যকর। লস্কর-ই-তৈয়বা হলো পাকিস্তানভিত্তিক একটি ইসলামী সন্ত্রাসী সংগঠন, যা ভারত ও আফগানিস্তানে কাজ করে। এটি আশির দশকের শেষের দিকে মারকাজ-উদ-দাওয়া-ওয়াল-ইরশাদের একটি জঙ্গি শাখা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। মারকাজ একটি ইসলামী সংগঠন, যা বাইরে থেকে আসা সুন্নি ইসলামের ওয়াহাবি অংশের দ্বারা প্রভাবিত এবং এর চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা।
বিপরীতে হামাস একটি ফিলিস্তিনি ভূমিজাত আন্দোলন, যার একমাত্র লক্ষ্য সেখানে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান। হামাস ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদকে ইসলামী প্রেক্ষাপটে প্রচার করে। তারা মনে করে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের উচিত ফিলিস্তিনি জনগণের সেবা করা, তাদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা করা এবং তাদের জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে কাজ করা। হামাস ফিলিস্তিনি জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ফিলিস্তিনি জনগণের ক্ষমতায়নের স্বাধীনতা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে।
যদি আদৌ কোনো সাদৃশ্য টানতে হয়, তাহলে হামাস উত্তর আয়ারল্যান্ডের সিন ফেইন এবং আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি নামে পরিচিত তার জঙ্গি শাখার নিকটতম হতে পারে। অস্বীকার করা যাবে না, ১৯৯৮ সালের গুড ফ্রাইডে চুক্তির পর উত্তর আয়ারল্যান্ডে এক সিকি শতক ধরে শান্তি বজায় রয়েছে। এ ঘটনাই আশা জাগিয়ে রাখছে যে শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ওপর চাপানো ইতিহাসের বোঝাও তুলে নেওয়া হতে পারে। একটি সভ্য রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে শুধু ইতিহাসের এই গভীর উপলব্ধি নিয়ে কাজ করা উচিত।
এম কে ভদ্রকুমার: ভারতীয় সাবেক কূটনীতিক; ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন থেকে ভাষান্তর করেছেন সাইফুর রহমান তপন