ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

নির্বাচন

ছলে বলে কৌশলে জেতা যায়, কিন্তু…

ছলে বলে কৌশলে জেতা যায়, কিন্তু…

আবু সাঈদ খান

আবু সাঈদ খান

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২২:৫২

আমার কৈশোর কেটেছে গ্রামে। তখন শীতের মৌসুমে যাত্রাগানের ধুম পড়ত। অধিকাংশ যাত্রাপালাতে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হতো। রাজা বা সেনাপতি প্রতিপক্ষকে বুক ফুলিয়ে বলতেন, ছলে বলে কৌশলে তোমাকে পরাস্ত করবই। ছল, বল ও কৌশলই সামন্ত যুগের বিধান। তবে সত্যিকার বীরদের মধ্যে মূল্যবোধও ছিল। তখন যুদ্ধের ময়দানে নিরস্ত্র প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণ করা হতো না, বন্দিদের যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদর্শন করা হতো।

১৫৯৭ সালে বিক্রমপুরের সন্নিকটে ঈশা খাঁর সঙ্গে মোগল বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রাজা মানসিংহের পুত্র দুর্জনসিংহ নিহত হন। কথিত আছে, পুত্র হত্যার বদলা নিতে বিশাল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন স্বয়ং মোগল সেনাপতি মানসিংহ। ঈশা খাঁ অহেতুক রক্তপাত না ঘটিয়ে মোগল সেনানায়ককে তাঁর সঙ্গে দ্বৈত যুদ্ধে আহ্বান জানান। এ প্রস্তাবে মানসিংহ সম্মত হন। শুরু হলো দুই বীরের যুদ্ধ। মোগল ও বঙ্গবাহিনীর সৈন্যরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখছেন। চরম উত্তেজনা; কে হারেন, কে জেতেন? হঠাৎ মানসিংহের তরবারি হস্তচ্যুত হয়। ঈশা খাঁ মানসিংহকে আঘাত না করে তাঁকে নিজের তরবারি এগিয়ে দেন। মানসিংহ প্রশ্ন করলেন, সুযোগ পেয়েও আমাকে আক্রমণ করলেন না কেন? জবাবে ঈশা খাঁ বললেন, নিরস্ত্র ব্যক্তিকে আক্রমণ করা কাপুরুষের কাজ, তাতে কোনো বীরত্ব নেই। মুগ্ধ মানসিংহ ঈশা খাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। তাদের মধ্যে সন্ধি হলো। ঘটনাটির সত্যতা ইতিহাসবিদরা নিরূপণ করবেন। আমার কাছে শিক্ষাটা তাৎপর্যপূর্ণ। সামন্ত যুগেও নিরস্ত্র প্রতিপক্ষের ওপর হামলার মধ্যে বীরত্ব ছিল না, ছল ও কূট-কৌশল প্রয়োগও মর্যাদার বিষয় ছিল না।

দুর্ভাগ্যজনক যে, আমাদের রাজনীতিকরা সামন্ত যুগের ‘ছলে বলে কৌশলে’ প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার নীতি গ্রহণ করেছেন; নিরস্ত্র প্রতিপক্ষকে আক্রমণ না করার নীতি ধারণ করতে পারেননি। এর প্রমাণ গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ কেন্দ্র করে সরকারের আচরণ। সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে বিএনপির সভাকে কেবল পণ্ড করেই পুলিশ বাহিনী নিবৃত্ত হয়নি। তারা নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। এখনও নেতাকর্মীরা কার্যালয়ে যেতে পারছেন না। আর যাবেনই কী করে? এই ঘটনার পর ১০-১২ হাজার নেতাকর্মীকে জেলে পুরা হয়েছে। বিএনপি নেতাকে না পেয়ে ভাই বা বাবাকে তুলে এনেছে, এমনকি স্ত্রীকে ধরে এনে জেলে ঢুকিয়েছে। পাইকারি হারে মামলা দেওয়া হয়েছে। আসামির তালিকায় প্রবাসী ও মৃত ব্যক্তিরাও আছেন। ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় মামলার তালিকায় একজন আওয়ামী লীগ নেতার নামও ছিল। তাড়াহুড়া করায় এমন ভুল হয়েছে। তাড়াহুড়ার কারণ বোধগম্য, নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই সব নেতাকর্মীকে জেলে পোরার ছক। যত দ্রুত গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার চেয়ে দ্রুতগতিতে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। আরও ভয়াবহ ঘটনা, কিছু রহস্যজনক মৃত্যু ও অপহরণ। রাজশাহীতে প্লেটবিহীন সাদা মাইক্রোবাসে দুই জামায়াত সমর্থক চিকিৎসককে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সমকালের প্রতিবেদন, ‘জেলায় দুই চিকিৎসকের আলোচিত হত্যা, হরিয়ান বাজারে এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যাচেষ্টা, লালপুরে যুবদল নেতাকে মৃত ভেবে গর্তে ফেলে যাওয়ার সব ঘটনাতে পাওয়া গেছে সাদা মাইক্রোবাসটির সংশ্লিষ্টতা। … গত শুক্রবার একইভাবে লালপুরের বিলমাড়িয়া ইউনিয়ন যুবদল নেতা মাসুদ রানাকে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় একটি দল। তারা নির্জন স্থানে মাসুদকে রড দিয়ে পিটিয়ে ডান হাত ও ডান পা ভেঙে দেয়। চাকু দিয়ে শরীরে ক্ষত-বিক্ষত করার পর মৃত ভেবে একটি গর্তে ফেলে চলে যায়।’

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাসুদ জানান, রাত পৌনে ১০টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পথে সাদা মাইক্রোবাস এসে তাঁকে তুলে নেয়। তারা নাম-ঠিকানা জিজ্ঞাসা করার পরে বলে, ‘শালা ঢাকা গেছিলি? বিএনপি করিস? থানায় চল, বিএনপি করাচ্ছি।’ (সমকাল ৬ নভেম্বর ২০২৩)। এমন ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী, রংপুর, নাটোরসহ দেশের নানা স্থানে।
বিরোধী দলের প্রতি দমন-পীড়ন নতুন নয়, তবে বর্তমানের দমন-পীড়নের বিষয়টি ব্যতিক্রম। অতীতে নির্বাচনের সময়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে মুক্তি দেওয়া হতো, এবার নির্বাচনকে সামনে রেখে পূর্ণোদ্যমে ধরপাকড়, হামলা-মামলা হচ্ছে।

বলপ্রয়োগের পাশাপাশি কৌশলের খেলাও চলছে। নির্বাচনে ঢাক বাজাতে ক্ষমতাসীন দল ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও অভিনেতা ফেরদৌসকে প্রার্থী করেছে। বিএনপি নেতা শাজাহান ওমরকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে নৌকার প্রার্থী করা হয়েছে। এসব নিয়ে মুখরোচক আলোচনা হচ্ছে। তবে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো দাওয়াইতেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। 

সরকারের আরেকটি কৌশল কিংস পার্টি দাঁড় করানো। তৃণমূল বিএনপি, বিএনএমসহ কতিপয় কিংস পার্টি মাঠে নামিয়ে বিএনপি ভাঙার যে চেষ্টা  করা হয়েছিল, তা সফল হয়নি। তাদের অবস্থা ওয়ান ইলেভেনের সময়ে গঠিত ফেরদৌস কোরেশীর দলের মতো বেহাল। তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের ৩০০ সিটে প্রার্থী দাঁড় করানোর তোড়জোড়ও শূন্যে মিলিয়ে গেছে। অবশেষে এরা যেসব প্রার্থী দিয়েছে তার বেশির ভাগই অখ্যাত। তাদের দিয়ে প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচনের অভিনয়ও সম্ভব নয়। তাই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের ভরসা করতে হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ওপর। ইতোপূর্বে দলের মনোনয়নবঞ্চিতরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাদের বিদ্রোহী চিহ্নিত করা হতো। এমনকি দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। এবার ঘোষণা করা হয়েছে– স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতি দল নমনীয় থাকবে। এই ঘোষণার পরিণতিতে আওয়ামী লীগের চার শতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেছেন, যা এখন দলের অফিসিয়াল প্রার্থীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

গত ৩০ নভেম্বর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘পরিণতি যখন আসবে তখন বুঝতে পারবেন কৌশলটা। এর যথার্থতা তখন বোঝা যাবে। আমাদের কৌশল ভেবেই করেছি। তবে আমরা ঢালাওভাবে করব না। সময়মতো জানবেন।’ (প্রথম আলো, ১ ডিসেম্বর ২০২৩)। সহজেই আন্দাজ করা যায় যে, আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থীর একাংশকে প্রতিযোগিতা করার অনুমতি দেবে, অপর অংশকে বসিয়ে দেবে বা ডামি হিসেবে নির্বিকার থাকতে নির্দেশ দেবে। প্রশ্ন হচ্ছে, সে নির্দেশ সবাই মানবেন? তখন যা হবে তা কৌশলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। সে যাই হোক, এটি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর ক্ষেত্রে অভিনব কৌশল গ্রহণে আওয়ামী লীগ যথেষ্ট পারঙ্গম।

এই কৌশলের খেলায় অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে পড়েছে ১৪ দল ও মহাজোটের শরিকরা। ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের ভূমিকায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তবে তারা কি খালি হাতে যাবেন? জানতে চাইছেন, তাদের আসন কত? সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে ১৪ দলের শরিক রাশেদ খান মেননের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও হাসানুল হক ইনুর জাসদ। তাদের পক্ষে পুরোনো আসনগুলোর মনোনয়ন ধরে রাখা কঠিন। ইতোমধ্যে রাজধানীতে রাশেদ খানের সিটে আওয়ামী লীগ দলের কেন্দ্রীয় নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে মনোনয়ন দিয়েছে। এখন মেননের শেষ ভরসা বরিশালের নিজস্ব এলাকা। ইতোমধ্যে তিনি সেখানকার দুটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে থেকে একটি পেলেও পেতে পারেন। একদা আওয়ামী লীগের কাছে তাদের যে গুরুত্ব ছিল, এখন আর তা নেই। তারা এখন আওয়ামী লীগের করুণাপ্রার্থী।

আওয়ামী লীগ কৌশলের খেলায় সিদ্ধহস্ত। আমার মনে হয়, কৌশলের ক্যারিশমায় নির্বাচনের মাঠ খানিকটা উত্তপ্ত করে তুলতে পারবে, হয়তো নির্বাচনও করে ফেলবে। তবে প্রধান বিরোধী দল ছাড়া এবং বিরোধী দলের হাজারো নেতাকর্মীকে জেলে পুরে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে– তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কতখানি গ্রহণযোগ্যতা পাবে?  আর কৌশলের জাঁতাকলে যেসব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নিয়মনীতির বলি হচ্ছে, তার খেসারতই বা কে দেবে? 

আবু সাঈদ খান: লেখক ও গবেষক; উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল  

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×