
পৃথিবীর ৩০০ কোটি মানুষ ঠিক মতো খাবার পায় না। হতে পারে এরা আধপেটা হয়েই দিন কাটায়। কিংবা যে পরিমাণ খাবার তারা খেতে পায়, তার পুষ্টিমান খুবই কম। এই ৩০০ কোটি গরিব মানুষের বাস মূলত আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায়। এদের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপালসহ আরও কিছু দেশ আছে, যেখানকার শিশু, কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধরা অপুষ্টির জালে আটক। এই অপুষ্টির জাল সৃষ্টি করেছে কিছু মানুষ, যারা ধনী দেশের এবং তাদের ক্ষুধা নারকীয়। আপনি চাইলেই দেখতে পাবেন, আমেরিকার কিছু শিশু-কিশোর অবিসিটির শিকার। অতিমাত্রায় জাঙ্কফুড খাওয়ার কারণে তাদের এ অবস্থা। এর একটি সামাজিক প্রভাব উন্নয়নশীল দেশগুলোতে লেগেছে। এসব দেশের কিছু মানুষ ওই জাঙ্কফুডকেই আদর্শ মেনে ব্যবসা করছে। উঠতি ধনী, লুটেরা মননের পরিবার-পরিজনরা মনে করছে, ওই জাঙ্কফুডই আধুনিকতা আর বিশ্ব সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মেলানোর রাজপথ। এভাবেই মূলত বাড়ছে অখাদ্য-কুখাদ্যের ব্যবহার। বাংলাদেশের একটি সামাজিক শ্রেণি অর্থেবিত্তে ফুলেফেঁপে উঠছে, ঠিক এর বিপরীতে বেড়ে চলেছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। এই সামাজিক বৈষম্য গোটা দেশের অর্থনৈতিক চেহারায় বিভাজন তৈরি করছে। ক্রমেই হয়ে উঠছে এটি 'হ্যাব অ্যান্ড হ্যাবনট'দের ফারাকের মতোই সামাজিক বৈষম্যের এক মহাসংকট।
২.
বিশ্ব রাজনীতির নীলনকশা তৈরি হয় মূলত ধনী ও ক্ষমতাবানদের ইচ্ছায়। ক্ষমতা এমন এক মোহ, যা মানুষকে দানবে রূপান্তরিত করে। ক্ষমতা চায় আরও ক্ষমতার ব্যাসার্ধ। সেই ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে চাই ধন-সম্পদ। এ দুটির সমন্বিত রূপ হচ্ছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। এই দেশটি ৫০টি দেশের মিলিত রূপ আর বহুধাবিভক্ত চেতনার সম্মিলনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত, তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক চৈতন্যে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র একটি তটরেখায় মিলিত হয়েছে। তবে, সেই গণতন্ত্র তাদের নিজস্ব চেতনাজাত, বৈশ্বিক গণতন্ত্রের প্যাটার্নের সঙ্গে অনেকটাই ফারাক আছে। সুদীর্ঘকাল ধরে ওই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটির চর্চার ফলে ওই দেশের সাধারণের মনে তেমন কোনো প্রশ্ন জাগে না। যাদের মনে সেরকম প্রশ্ন জাগে তারা অতীব সোচ্চার ও স্পষ্টবাদী। রাষ্ট্র সেটা মেনে নিয়েই সেই প্রতিবাদীদের মানবাধিকারকে মূল্য দেয়। ওই প্রতিবাদ প্রতিরোধের ঘটনাগুলো তাদের রাজনৈতিক গণতন্ত্রের জন্য সৌন্দর্য বলে মনে করে। মার্কিনি ক্ষমতার অধিশ্বররা ওই সৌন্দর্য ব্যবহার করে বিশ্বের দরবারে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী কুটিল ও জটিল মনোভঙ্গিকে লুকিয়ে রাখে। লোভের লালসাকে রূপ দেয় তারা বিশ্বের দারিদ্র্য বিমোচনে গরিব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ক্ষুধা নিবারণের নানা উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ ও প্রকল্পের বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ফলে মার্কিনি লোভ ছাপিয়ে গরিবের চেতনায় ভাসতে থাকে ক্ষুধা নিবারণের সাহায্য-সহযোগিতাগুলো এবং প্রকল্পগুলো। ইউরোপে যে ধনবাদী গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে, তার সঙ্গে মার্কিনি স্বার্থ জড়িত হওয়ায় ঐক্য গড়ে তুলতে দেরি হয়নি। কারণ আমেরিকা ও ইউরোপীয় ধনবাদী গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে গরিব দেশ থেকে সম্পদ লুটে নিয়ে তাদের সম্পদ বাড়ানো। সেই সঙ্গে দরিদ্র দেশগুলোকে সেই সম্পদ থেকে যৎসামান্য দিয়ে নানা রকম মানবিক ও ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার এক 'মহাকাল্পনিক প্রকল্প' পরিচালনা করা। এই দ্বিমুখী নীতি আর তার আবরণ হিসেবে 'মানবতা'কে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের নীতি-আদর্শই সাম্রাজ্যবাদী লুটেরা ইউরোপের মৌলিক কর্মসূচি। এর আলোকে রচিত নীলনকশাটি সচল এখন পৃথিবীর সব গরিব দেশে।
৩.
সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা দেশগুলোর এই নীলনকশার বিপরীতে অতীতে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয়ভুক্ত গরিব দেশগুলোর আরেকটি নীলনকশা। তারা চাইত পৃথিবীতে সাম্য সমাজ গড়ে উঠুক। সেই সাম্য সমাজে থাকবে ক্ষুধামুক্ত জনজীবন। কিন্তু তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ব্যর্থতার সুতো ধরেই মূলত একটি দূরদর্শী রাজনৈতিক সংস্কারের ভেতর দিয়ে মাথা তুলেছে চীন। গণচীন তার রাজনৈতিক সংস্কার শুরু করে ১৯৭৬ সাল থেকে। গত চল্লিশ বছরে তাদের উত্থান পরাশক্তির মতোই। ওদিকে পতিত সোভিয়েতের অংশ রাশিয়া তার দুর্দিন কাটিয়ে উঠেছে বলা যায়। এখন রাজনৈতিক ও সামরিক বিবেচনায় গোটা পৃথিবী আবারও 'স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালের' মতোই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। মার্কিনি নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব। আর চীন ও রাশিয়ার মিলিত নেতৃত্বাধীন অগণতান্ত্রিক বা প্রায় একদলীয় শাসনাধীন টাইরান্ট ও কর্তৃত্ববাদী বিশ্ব।
বাংলাদেশ এই দুই প্যাটার্নের কোন পার্টে আছে, বলা মুশকিল। স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টার নানা প্যাটার্ন থেকে মনে হয় তারা টাইরান্ট ও কর্তৃত্ববাদী হিসেবেই নিজেদের চিনিয়েছেন। নিজেদের ক্ষমতা অব্যাহত রাখার স্বার্থে যখন যে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তারা সেটাই করেছে।
৪.
বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে ধনবাদী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মনের কোণে উদিত মানবিকতার আকাশ উন্মুক্ত থাকলেও সেই খাতে মানুষের 'ক্ষুধা নিবারণে'র প্রণোদনা তেমন শক্তিশালী নয়। লোক দেখানো প্রকল্প থাকলেও সেখানে প্রকৃত ক্ষুধামুক্তির আয়োজন তেমন একটা অবদান রাখতে পারে না। তাদের অর্থ বিনিয়োজিত হয় সামরিক খাতে সবচেয়ে বেশি। বিপরীতে রাশিয়াও একচ্ছত্রভাবে তাদের সামরিক খাতে বিনিয়োগ করছে বিপুলভাবে। কারণ তারা চায় সেই পুরোনো ক্ষমতার সিংহাসনে বসতে, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল। আর চীন চায় তার আঞ্চলিক ক্ষমতার সিংহাসন থেকে নিজেকে বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছাতে। তবে এর জন্য মূলত দায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার উদগ্র বাসনার কারণেই চীনকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে উত্তর ও দক্ষিণ চীন সাগর ও ইন্দো-প্যাসিফিকে ক্ষমতার দাপট দেখানো এবং মালাক্কা প্রণালি দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করায় চীন এর মধ্যেই বিকল্প পথ সৃজন করেছে। পাকিস্তানের গারোদা বন্দর তাদের সেই অলটারনেটিভ ওয়ে আজ তো সবাই জানে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত আর যুক্তরাষ্ট্র মিলে যে কোয়াড গড়েছে, সেই অসামরিক সংস্থাকে সামরিক জোটে পরিণত করতে কতক্ষণ লাগবে যুক্তরাষ্ট্রের, তা ভাবনার বিষয় নয়। কারণ কোয়াডের উদ্গাতা দেশ জাপান শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছারই অধীন নয়, রাজনৈতিক সহযোগীও। দরিদ্র বিশ্বের ক্ষুধামুক্তি নয়, সেই পুরোনো ক্ষমতারই উদগ্র বাসনার নীলনকশা আবারও মাথায় চড়েছে তাদের। এ থেকে গরিব পৃথিবীর 'মানুষ'কে মুক্তি দিতে হবে। না হলে ক্ষুধামুক্ত ভারসাম্যময় বিশ্ব রচনা কোনো কালেই সম্ভব হবে না।
কবি ও সাংবাদিক
মন্তব্য করুন