
পৃথিবীতে অনেকবার মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ যেমন পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি মহামারিও কোনো পরিসরে সীমাবদ্ধ না থেকে বিশ্বময় ছড়িয়ে যায়। করোনা মহামারিও গত পনেরো মাসব্যাপী সব মানচিত্রের দেয়াল টপকে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানের ভাষায় এই 'বৈশ্বিক মহামারির ভয়াল থাবায় আজ মানব জাতির জীবন এবং গোটা বিশ্ব বিপন্ন ও বিপর্যস্ত।' ২০১১ সালে চীনের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের হাসিন মাংহায় প্রত্নতত্ত্ববিদরা পাঁচ হাজার বছরের আগের গণকবরের সন্ধান পেয়েছিলেন। বিজ্ঞানীরা ওই ঘটনাকে এ যাবৎকালের প্রাচীন মহামারির নিদর্শন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
৪২৬ থেকে ৪৩০ খ্রিষ্টপূর্ব সময়কালে গ্রিসের এথেন্সে প্লেগ মহামারির আবির্ভাব ঘটে। তাও ক্রমেই ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল। এথেন্সে তখন চলছিল স্পার্টার যুদ্ধ। যুদ্ধের ভয়াবহতা অতিক্রম করে প্লেগ মহামারির শিকার হয়েছিল অগণিত মানুষ। রোমান সাম্রাজ্য মহামারির কবলে পড়েছিল ১৬৫ থেকে ১৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। রোমান সাম্রাজ্যের আধিপত্য তখন বিশ্বজুড়ে শৌর্যের শীর্ষে। তখন পার্থিয়া থেকে যুদ্ধফেরত সৈনিকরা বহন করে এনেছিল অচেনা-অজানা রোগটি। ওই রোগে আক্রান্ত হয়ে রোমের চার ভাগের এক ভাগ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। গ্রিক চিকিৎসক ও দার্শনিক গ্যালেন এই রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তা থেকেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছিলেন রোগটি ছিল 'গুটি বসন্ত'। গ্যালেনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মহামারিটি 'গ্যালেনের মহামারি' নামে পরিচিতি লাভ করে। ওই মহামারিকালে রোমান সাম্রাজ্যের সিংহাসনে থাকা দুই সম্রাট লুসিয়াস ভেরাস, মার্কাস অরেলিয়াসসহ পঞ্চাশ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। কথিত আছে, ওই মহামারিই রোমান সাম্রাজ্য পতনের সূচনা করেছিল। রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের পারিবারিক পদবি অনুযায়ী এই রোগের অন্য নামকরণ করা হয়েছিল 'আন্তোনিন প্লেগ'। এই মহামারিও চীনে উৎপত্তি বলে অনেকে মত প্রকাশ করেছিল।
তারপর কিছুটা বিরতি দিয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল 'জাস্টিনিয়ানের প্লেগ'। বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানের শাসনামলে ওই মহামারি সম্রাটের বিস্তৃত সাম্রাজ্যের শস্য পরিবহনের পথ ধরে রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে দ্রুত পৌঁছে যায় এবং বিস্তার লাভ করে। শস্যের সঙ্গে থাকা ইঁদুর ও একপ্রকার মাছি রোগটি ছড়িয়ে দিয়েছিল মানবদেহে। তখন এত বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল যে, মৃতদেহের সৎকার করার উপায় ছিল না। ওই উপসর্গ নিয়ে ১৩৪৭ সালে আটশ বছর পরে চড়াও হয় মহামারি। নানা নামকরণের পর রোগটির চূড়ান্ত নামকরণ করা হয় 'ব্ল্যাক ডেথ' (কালো মৃত্যু)। ওই রোগ মাত্র পাঁচ বছরে কালো মৃত্যুর ছোবলে ইউরোপের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ মানুষের প্রাণ হরণ করে। প্রাণঘাতী ওই দুই মহামারির কারণ অনুসন্ধান করতে অপেক্ষা করতে হয়েছে উনিশ শতকের শেষ অবধি পর্যন্ত। ১৮৯৪ সালে পাস্তুর ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী আলেকজান্দ্রে ইয়েরসিন প্লেগ রোগের জীবাণু আবিস্কার করেন এবং জীবাণুর নামকরণ করা হয় 'ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস'। রোগের নাম প্লেগ। প্লেগ শব্দটি মহামারির প্রতিশব্দও বটে। ওই সময় থেকে 'কোয়ারেন্টাইন' সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হয়ে উঠেছিল। সংগনিরোধ বা স্পর্শমুক্ত থাকার নিয়ম চালু হয়েছিল। আজকের করোনা থেকে রক্ষাকবচ হিসেবে ওই একই ফর্মুলা আমরা অনুসরণ করছি।
সব মহামারি নির্মূল হয়েছে, তা বলা যাবে না। পৃথিবী থেকে স্থায়ীভাবে বিদায় নিয়েছে গুটি বসন্ত। গুটিবসন্তে আমেরিকার অ্যাজটেক ও ইনকা সভ্যতার প্রায় ৯০ শতাংশ অধিবাসীর জীবন এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ৭০ শতাংশ মানুষের জীবন হরণ করেছিল। পৃথিবীজুড়ে গুটি বসন্তে প্রাণ হারায় প্রায় ১০০ কোটি মানুষ। ১৮১৭ সালে প্রথম কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে প্রায় সব দেশে। জনস্বাস্থ্য উন্নতির কারণে কলেরা নিয়ন্ত্রণে এলেও, ইন্দোনেশিয়ায় সপ্তম কলেরা প্রকোপ শুরু হয় এবং আমাদের উপমহাদেশের বাইরে প্রথম যাত্রা শুরু করে। এখনও যুদ্ধ এবং বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ২০১০ সালে কলেরায় হাইতিতে আট হাজার মানুষ মারা যায়।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর স্প্যানিশ ফ্লু হানা দেয়। ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া ওই ফ্লুতে মাত্র দুই বছরে পঞ্চাশ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়। প্রাণ হারায় পাঁচ কোটি মানুষ। চিকিৎসা কেন্দ্রে ঠাঁই না হওয়ায় স্কুল, অডিটোরিয়াম ও তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট এই রোগের লক্ষণ হাঁচি, কাশি, জ্বর দিয়ে শুরু এবং আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বয়স্করা সর্বাধিক মৃত্যুবরণ করে। কোনো প্রতিষেধক না থাকায় রোগ প্রতিরোধে কোয়ারেন্টাইনকে রক্ষাকবচ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষায় যেমন স্বাস্থ্যবিধি আরোপ করা হয়েছে, একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু মহামারিকালেও। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় পরবর্তী বিশ বছরে এই ফ্লুর টিকা আবিস্কার ও ব্যবহার শুরু হওয়ার পর মানুষের কিছুটা মুক্তি ঘটে। তবে ফ্লু বারংবার রূপ পরিবর্তন করার ফলে বারবার বিজ্ঞানীরা টিকা পরিবর্তনে বাধ্য হন। আর তাই নতুন করে টিকা নিতে হয়। শেষ পর্যন্ত এভাবেই স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ন্ত্রণে আসে।
সার্স ও মার্স দুটি রোগই করোনাভাইরাসের অন্তর্গত। বিজ্ঞানীদের ক্রমাগত সতর্কতার নির্দেশ ও বৈশ্বিক মহামারির ভয়াবহতা ও ব্যাপক প্রাণ-সংহারের বিষয়টি আমলে নেননি রাষ্ট্র, নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারকরা। বিজ্ঞানীরা থেমে থাকেননি। মুখাপেক্ষী হননি অলৌকিকতার পানে। বরং যুক্তি, বুদ্ধি, মেধা ও শ্রমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন করোনা মহামারি প্রতিরোধে। ইতোমধ্যে প্রতিষেধক টিকা আবিস্কার হয়েছে। মানবদেহে প্রয়োগও হচ্ছে। তবে করোনাভাইরাসও রূপ বদলে নতুন রূপ গ্রহণ করছে। তাতে টিকারও নিশ্চয় পরিবর্তন করে বিজ্ঞানীরাই রক্ষা করবেন মানব জাতিকে।
নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
মন্তব্য করুন