
গত শুক্রবার ৬ আগস্ট রাত ৮টায় ফেসবুকে আমি একটি পোস্টে লিখি :'মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের প্রতি বিনীত আবেদন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এই নির্দেশ দিন যেন কোনো নাগরিককে কোনো অপরাধের অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক বা গ্রেপ্তার করার সময় তার ব্যক্তিমর্যাদা হরণ করা না হয়। কোনো আইনানুগ নাগরিককে অনুরূপ আটক বা গ্রেপ্তারের সময় তাকে সুনির্দিষ্ট কারণ বা পরোয়ানার বিষয় না জানিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে জনসমক্ষে আতঙ্ক সৃষ্টি পুলিশের আইনি ও কাঙ্ক্ষিত আচরণ হতে পারে না। দয়া করে এদিকে নজর দিন। পরীমণি ও চয়নিকা চৌধুরীকে আটক করা ও কোনো সশস্ত্র সন্ত্রাসীকে আটক করা সমার্থক নয়। এই ঘটনাগুলো এবং মিডিয়ায় প্রদর্শিত ছবিগুলো স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করছে।'
এই পোস্ট দেওয়ার কিছুক্ষণ আগে টেলিভিশনে দেখছিলাম খ্যাতিমান নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীকে জনসমক্ষে তারই ব্যক্তিগত মোটরগাড়িতে গোয়েন্দা বিভাগের লোকজনের নিয়ে যাওয়ার সংবাদচিত্র। নিজের গাড়িতে উঠতেই প্রথমে পুলিশের ইউনিফর্ম ছাড়া সাদা পোশাকের ক'জন লোক চয়নিকাকে কিছু বলে হাতের ইশারায় নামতে ইঙ্গিত করছিলেন। তাদের কেউ গোয়েন্দা পুলিশের কটি পরা, কেউ তা নয়। তারা চয়নিকার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে তিনি নামলেন, আবার উঠলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে একজন নারী পুলিশ অফিসার ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটটিতেই চয়নিকার সঙ্গে ঠেসেঠুসে বসে তার একটি হাত ধরে রাখলেন। একটি টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার হাতের বুম গাড়ির অর্ধেক নামানো জানালায় ধরে রেখেছিলেন, গাড়ি চলতেই 'আমাকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায় জানি না, বলে না, কিছু বলে নাই'- আর্তস্বরে চয়নিকার এ কথা শোনা গেল।
পরের খবরে জানা যায়, তাকে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অফিসে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তিন ঘণ্টা পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি সাংবাদিকদের বললেন, আইনের প্রতি তার শ্রদ্ধা রয়েছে, পুলিশকে সবরকম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, তবে সবকিছু আইনে হতে হবে।
খবরে জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃত চলচ্চিত্রাভিনেত্রী পরীমণির বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়। তিনি পরীমণির ঘনিষ্ঠ এবং ওর অভিনীত সিনেমার পরিচালক। আমাদের প্রশ্ন, এই কাজটা রাস্তার মধ্যে নাটক করে ধরে না নিয়ে চয়নিকা চৌধুরীর বাসায় গিয়ে বা তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে করা যেত না? হয়রানি করতে নয়, আইনি প্রয়োজনে তাকে যতবার খুশি ডাকা যাবে। ওই ঘটনায় টেলিভিশনের পর্দায় একমাত্র নারী পুলিশ সদস্যকে দেখা গেছে পোশাকে। অন্য ডিবি সদস্যরা ছিলেন সাদা পোশাকে। দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহু সংখ্যক 'গুম' ও 'তুলে নিয়ে যাওয়ার' ঘটনার পটভূমিতে এরকমভাবে ধরা কতটা আতঙ্কের হতে পারে, তা পুলিশ কর্মকর্তারা কী বোঝেন না? জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিতে কেন চয়নিকার গাড়ি ঘিরে সাদা পোশাকে ওঁৎ পেতে বসে থাকতে হবে? তিনি কি সন্ত্রাসী, না রাজনৈতিক বিপ্লবী? নাকি সব কাজে পুলিশকে অহেতুক বীরত্ব দেখাতেই হবে?
আমাদের পুলিশ বাহিনী ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব এবং অন্য বাহিনীগুলোর সত্যিই অনেক বীরত্বপূর্ণ কাজ আমরা সম্প্রতি দেখেছি। ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গিদের হামলায় দু'জন পুলিশ সদস্য, ১৭ জন বিদেশিসহ সর্বমোট ২৯ জন নিহত হওয়ার পর দেশে ধারাবাহিক অভিযানে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে এনে দেশে নিরাপত্তা বিষয়ে অনেকটা স্বস্তি তৈরি করা তাদের অন্যতম সাফল্য। জাতীয় দায়িত্ব পালন ও বীরত্বের স্বীকৃতি তাদের অবশ্যই প্রাপ্য এবং তা দিতে দেশবাসী কুণ্ঠিত নয়।
আবার ২০০৪ সালে র্যাবের জন্মের পরপরই বাহিনীটি জড়িয়ে পড়েছিল দেশে-বিদেশে তীব্রভাবে সমালোচিত এক ভয়ংকর কার্যক্রমে, যার নাম 'ক্রসফায়ার'। প্রথমদিকে কিছু দুর্ধর্ষ অপরাধী ধরা পড়ার পর ভোররাতে অস্পষ্ট অভিযানে মারা পড়লে এর প্রতি ভ্রান্তিবশত একটি জনসমর্থনও লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কিন্তু যতই অস্বীকার করা হোক, এই কার্যক্রম যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তাতে এখন আর কেউ সন্দেহ করে না। শব্দটিই আমাদের নিত্যব্যবহারের আওতায় এসে গেছে, যেমন গ্রাম্য উক্তি 'ওরে ক্রসফায়ারে দে' অথবা 'ধর্ষণের শাস্তি ক্রসফায়ার' বলে খোদ আইনপ্রণেতাদের মুখেই অকল্পনীয় আওয়াজ। এর ভয় দেখিয়ে পুলিশের চাঁদাবাজির অভিযোগ এখন আর বিরল নয়। মাদকের বিরুদ্ধে ২০১৮-এর অভিযানে নিত্য 'বন্দুকযুদ্ধের' মধ্যে টেকনাফের আওয়ামী লীগ দলীয় পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের করুণ মৃত্যু ও ভাইরাল হওয়া ফোনে তার কিশোরী কন্যার 'আব্বু তুমি কান্না করতেছ যে' আর্তনাদ এখনও অনেকের কানে বেজে চলেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অপর এক মন্ত্রী 'এ ধরনের অভিযানে দু-একটা ভুল হতেই পারে' বলে মন্তব্য করেছিলেন।
এই করুণ ও অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো স্মরণ করতে হলো এই কথাটা বলতে যে, বেআইনিভাবে আইন প্রয়োগ করার সুযোগ বা অধিকার পুলিশকে দেওয়া হলে তা অব্যাহত থাকবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকতা, আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থা ক্ষয়ে যেতে থাকবে।
বেআইনিভাবে আইন প্রয়োগের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত ইদানীং সামনে আসছে, যেগুলো নিয়ে আর প্রশ্নও করা হয় না, 'স্বাভাবিক' বলে মেনে নেওয়া হচ্ছে। এর একটি হলো সাদা পোশাকে পুলিশের কাজ করা। একান্ত বিশেষ কিছু গোয়েন্দা কার্যক্রম ছাড়া আসামি ধরা, গ্রেপ্তার প্রভৃতি কাজ পুলিশের সাদা পোশাকে করা অনুমোদনযোগ্য নয়। এই নিয়ম না মানলে পুলিশের কিছু দুর্নীতিবাজ সদস্য ও বাইরের দুর্বৃত্তদের কাজ একাকার হয়ে নাগরিক নিরাপত্তা বিপন্ন করে তুলতে পারে। চাঁদাবাজি, অপহরণ ও গুমের ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে।
আরেকটি হচ্ছে, আটক করে নিয়ে কয়েকদিন অজ্ঞাত স্থানে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন চালিয়ে পরে অন্য তারিখে থানায় গ্রেপ্তারের নথি লিপিবদ্ধ করানো ও পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে নেওয়া। এই বেআইনি বন্দিত্বের সময়টিকে ভিকটিম আর কিছুতেই প্রমাণ করতে পারেন না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দি অবস্থায় গত ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে মরে যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ (৫৩) ও প্রায় পঙ্গু অবস্থায় ৪ মার্চ জামিনে মুক্তি পাওয়া কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে। দু'জনকেই ধরে নেওয়ার কয়েকদিন পরে আনুষ্ঠানিক গ্রেপ্তার দেখানো হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন যে, 'কারাগারে কোনো নির্যাতন করা হয়নি', তখন তিনি সত্যই বলেন। কারণ নথিতে লিখে কারাগারে দেওয়াই হয়েছে অজ্ঞাত স্থানে নির্যাতন করার পরে।
কিশোর গত ১০ মার্চ ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা করেন। তার অভিযোগ, ২০২০ সালের ২ মে অজ্ঞাতপরিচয় কয়েক ব্যক্তি তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং তিন দিন নির্যাতনের পর তাকে র্যাবের কাছে হস্তান্তর করে।
বর্তমান অবস্থায় এটা অলীক আশা যে, পুলিশ এই মামলাটি আদৌ তদন্ত করবে। তবু কিশোর যে প্রতিকার ও ন্যায়বিচার চেয়েছেন, এই সাহসটুকুকে সম্মান জানাতে হয়।
চয়নিকা চৌধুরীকে রাস্তা থেকে ধরে নেওয়ার এক দিন আগে বনানীর বাসা থেকে চলচ্চিত্রের উঠতি জনপ্রিয় নায়িকা পরীমণিকে র্যাব যেভাবে আটক ও পরে গ্রেপ্তার করল সে-সম্পর্কে একটি প্রশ্ন করে লেখাটা শেষ করছি। এই ঘটনা মিডিয়ায় এত বেশি প্রচারিত যে, সবাই জানেন। প্রশ্নটিও ইতোমধ্যে শ্রদ্ধাভাজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও লেখক-কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তুলেছেন। এখন পর্যন্ত আমরা জানি যে, পরীমণির বিরুদ্ধে ধর্তব্য একটিই অভিযোগ, তা হলো তার বাড়িতে কিছু মাদক পাওয়া গেছে। শুধু গৃহকর্মী-পরিচারিকা নিয়ে বসবাসকারী একজন নারীর বাসায় যে পরিমাণ মাদক পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা উদ্ধারের জন্য বড়জোর থানা পুলিশের সহায়তায় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গেলে হতো না? বিভিন্ন পদমর্যাদার আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত বহুসংখ্যক র্যাব সদস্যের মহড়া ও সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে বাসা তল্লাশির পেছনে কি শুধু আইন প্রয়োগ, না অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? আর এত বড় অভিযানে কত খরচ হয়েছে? রাষ্ট্রের ব্যয়ের টাকা যদি জনগণের টাকা হয়, তাহলে তো জবাবদিহি থাকার কথা। পুলিশ যেমন বিক্ষোভ দমন করতে আইনত প্রয়োজনের অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করতে পারে না, তেমনি অহেতুক অতিরিক্ত ব্যয় করতে পারি কি?
জানি, উত্তর পাওয়া যাবে না। তাই পাঠকদের কাছেই একটা প্রশ্ন রাখি :এমন জবাবদিহিহীন, গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতাহীন পুলিশি প্রশাসন যদি চলতে থাকে, তাহলে এমন সময় কি আসতে পারে না, যখন কে যে কার হয়ে কার জন্য কোথায় কখন কী করছে তার হদিস করা যাচ্ছে না? দেশের জন্য পরিস্থিতিটা কি সুখকর হবে?
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
মন্তব্য করুন