দামের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই যেভাবে চালের দাম নতুন করে বেড়েছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। বস্তুত এ সময় চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি অনেকের জন্যই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শুক্রবার সমকালের একটি প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি, দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার খোলাবাজারে চাল বিক্রি করলেও বাজারে এর দাম কমছে না, বরং গত কয়েক দিনে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। আগে খোলাবাজারে বিক্রির ঘোষণা দিলেই চালের দাম কমে যেত। চাল বিতরণ শুরু করলে বাজারে আরও ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। এখন নিয়মিত ওএমএসের পাশাপাশি বিশেষ ওএমএস কার্যক্রম শুরুর পরও চালের দাম কেন কমছে না? আমরা মনে করি, বিষয়টি খতিয়ে দেখা জরুরি।

করোনা অতিমারির মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে এভাবে চালের দামের অস্থিতিশীলতা মেনে নেওয়ার মতো নয়। এজন্যই ওএমএসের কার্যক্রমে ঢিল দেওয়া যাবে না। বাজারের বর্তমান অবস্থায় চালের দাম কমাতে হলে পুরোদমে ওএমএস কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সরকারের কাছে চালের মজুদ থাকা যেমন দরকার, এর চেয়ে বেশি জরুরি তা অসহায়দের কাছে পৌঁছানো। করোনাকালে নিম্নবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাদের পাশে দাঁড়াতে টিসিবির ট্রাকসেল ও ওএমএস কার্যক্রম জোরদার করার বিকল্প নেই। এ সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা লিখেছি, টিসিবির পণ্য ও খোলাবাজারে ওএমএসের চাল প্রধানত নিম্নবিত্তের জন্য হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে মধ্যবিত্তও দাঁড়াচ্ছে। গত বছর থেকে করোনা অতিমারির প্রভাবে মধ্যবিত্তের অনেকেই যে সংকটে পড়েছেন, তা স্পষ্ট।

অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন এবং অধিকাংশ পরিবারের আয় কমার চিত্র বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ফলে সংকটে পড়া মধ্যবিত্তরা উপায়ান্তর না দেখে ভিড় করছেন টিসিবি-ওএমএসের পণ্যে। সংকট সমাধানে ওএমএস কিংবা টিসিবির কার্যক্রম জোরদার করা সাময়িক ব্যবস্থা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চালের বাজার যেভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং মৌসুমের মধ্যবর্তী সময়েও কারণ ছাড়াই দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার বিপরীতে প্রশাসনের পদক্ষেপ সামান্যই দেখছি আমরা। আমরা জানি, চালসহ খাদ্যপণ্যের বাজারে লাভের গুড় অধিকাংশই খায় মধ্যস্বত্বভোগী।

কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মিল মালিকরা মজুদ করেন এবং তারাই ধানের ভরা মৌসুমেও কারসাজি করে চালের দাম বাড়াচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, চালের বাজারে এমন কিছু মাফিয়া সৃষ্টি হয়েছে, যারা চালের দাম তো কমাচ্ছেই না, উপরন্তু বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কোটি টাকা ঋণ নিয়ে চাল মজুদ করে রাখছে। তারা সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। কারা অন্যায়ভাবে এসব কারসাজি করছে, প্রশাসন চাইলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। ব্যবসায়ীদের মতে, মোটা চালের পাইকারি মূল্য যেখানে ৪১ টাকা, সেখানে খুচরা বাজারে কেন এই চাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; এর তদারকি জরুরি। আমরা মনে করি, চালের কারসাজি যারা করছে তারা প্রশাসনের চেয়ে শক্তিশালী নয়। গুটিকতক ব্যবসায়ীর জন্য মানুষের ভোগান্তি এবং বাজারের অস্থিতিশীলতা হতাশাজনক। এজন্য কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি। পদক্ষেপ নিতে হবে সার্বিক বাজার ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেও।

চালের সঙ্গে ডিম, মুরগি, চিনি, ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামেও লাগাম টানতে হবে। এতদিন লকডাউনের অজুহাতে ব্যবসায়ীরা উল্লেখযোগ্য দ্রব্যের দাম বড়িয়ে দিয়েছিল। এখন যেহেতু করোনার বিধিনিষেধ উঠে গেছে, বাজারে যাতে কোনো পণ্যের সরবরাহে সংকট না হয় সেদিকে প্রশাসনকে দৃষ্টি দিতেই হবে। চালের বাজারের স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সরকারের আমদানির বিকল্প নেই। সরকার এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তবে সিদ্ধান্ত নিলেই হবে না, দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বিশেষ করে আমন ধানের মৌসুম আসতে দেরি আছে বলে দ্রুততম সময়ে চাল আমদানি করে বাজারে সরবরাহ বাড়াতেই মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি, বাজারে সার্বক্ষণিক নজরদারির বিষয়টিও ভুলে গেলে চলবে না।