- মতামত
- প্রবীণের জীবনযুদ্ধ
প্রবীণের জীবনযুদ্ধ
বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিপুলসংখ্যক প্রবীণ এখন কেবল বেঁচে থাকার জন্যই হাত বাড়িয়ে আছেন নিকটজনের দিকে। কিন্তু একটু সহায়তা, কৃতজ্ঞতা ও সহানুভূতি জানানোর সময়-সুযোগও অনেকের হয় না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুভয়। দেশ ও অঞ্চলভেদে এই ভাইরাস সংক্রমণে ভিন্নতা দেখা গেলেও প্রবীণ জনগোষ্ঠীই অধিকতর মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক উপাত্তেও লক্ষণীয়। আর এসব মানুষের যদি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদযন্ত্রের সমস্যা থাকে তো তাদের অবস্থান মৃত্যুর অতি নিকটেই বলে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। সংগত কারণেই অধিকাংশ বয়স্ক মানুষ নিতান্ত বাধ্য না হলে এখন আর ঘরের বাইরে যাচ্ছেন না। এতেও দেখা দিচ্ছে নানা বিপত্তি। অনেকেরই রয়েছে খাবারের অভাব, আবার কেউ কেউ পাচ্ছেন না প্রয়োজনীয় ওষুধ। ফলে তাদের কাছে জীবন অনেকটাই দুর্বিষহ।
করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্বব্যাপী ভীতিকর ও অনিশ্চিত এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তবে বাংলাদেশের বয়স্করা কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কথা শুনে; তিনি বলেছেন, 'করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বয়স্করা বেশি সংখ্যায় মারা যাচ্ছেন। কিন্তু টিকা নেওয়ার হার তাদের মধ্যে কম। গণটিকাদান কর্মসূচিতে গ্রাম, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত টিকা দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে বয়স্কদের প্রতি অধিক নজর দেওয়া হবে।' স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পূর্বঘোষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী গণটিকাদান কর্মসূচি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এর আওতায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পঞ্চাশের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী, নারী ও শারীরিক প্রতিবন্ধী দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠী থাকলেও বাস্তবে অনেকেই টিকা পাননি। টিকার স্বল্পতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে বয়স্কদের মনে শঙ্কা বেড়েছে।
বাংলাদেশে যাদের আয় কম, অভাব নিত্যসঙ্গী, মানবিক সদাচরণের ধারণা নেই, তাদের পরিবারে বৃদ্ধদের অবস্থা আরও করুণ। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা, ২০১৩-তে বলা হয়েছে, 'জাতিসংঘ ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের ৬০ (ষাট) বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিরা প্রবীণ হিসেবে স্বীকৃত হবেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী ২০১৮ সালে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে দেশে প্রায় এক কোটি ৩৫ লাখ মানুষ ছিল। গৃহ ও জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী দুই-তৃতীয়াংশের অধিক এ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে অক্ষম অবস্থায় রয়েছেন। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু ৭১ বছর ৬ মাস। প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী সিনিয়র নাগরিকদের সমাজে বৈষম্যমুক্ত ও নিপীড়নমুক্ত নিরাপদ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
গত কয়েক দশকে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু অর্জন রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর হার কমানো। ২৭ বছরে শিশুমৃত্যু কমেছে ৬৭ শতাংশ। প্রজনন হার কমানোর ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ১৯৭৫ সালে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী একজন নারী গড়ে ৬ দশমিক ৩টি সন্তানের জন্ম দিতেন। এখন একজন মা গড়ে ২ দশমিক ৩টি শিশু জন্ম দেন। মে মাসে প্রকাশিত এক নীতিপত্রে ইউনিসেফ বলেছে, বাংলাদেশে ১৯৭৮ সাল থেকে মোট জনসংখ্যায় কর্মক্ষম মানুষের হার বাড়তে থাকে।
সরকার 'মাতা-পিতার ভরণপোষণ আইন' (ফিডিং অ্যান্ড লজিং টু প্যারেন্টস অ্যাক্ট, ২০১৩) পাস করে। আইনে ভরণপোষণ বলতে খাবার, বস্ত্র, চিকিৎসা, বসবাস ও সঙ্গ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি এই আইন অমান্য করলে প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারযোগ্য হবে। এতে আপস নিষ্পত্তির ধারাও সংযুক্ত আছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা; এগুলো এখনও কাগজপত্রের ভেতরেই রয়েছে।
বাসস্থানের পরিকল্পনা অনুমোদনের ক্ষেত্রে মা-বাবার থাকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা ও জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি, প্রবীণ ফাউন্ডেশন গঠন করতে হবে, প্রবীণদের জন্য সরকারি বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা দরকার, অর্থনৈতিক মুক্তি ও তথ্যের মাধ্যমে প্রবীণদের ক্ষমতায়ন প্রয়োজন, প্রবীণদের ২৪ ঘণ্টা থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, সমবয়সী বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি, হাসপাতাল, বিমানবন্দর ও স্বাস্থ্যসেবায় প্রবীণদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুযোগ দেওয়া দরকার এবং সামাজিক সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হওয়া প্রয়োজন।
rezaul.natore@yahoo.com
মন্তব্য করুন