আওয়ামী রাজনীতির একজন সাধারণ কর্মী ছিলাম আশির দশকের মাঝামাঝি। রংপুরে তখন স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন সবে দানা বেঁধে উঠছে। ঢাকায় রাউফুন বসুনিয়া, দিপালীরা রক্ত দিয়েছে। আরও অনেকের মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই চলছে। এই চেতনার আগুনের পরশমণি তখন অসংখ্য ছাত্র-জনতার মতো বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার ইস্পাত কঠিন হৃদয়ে জ্বলছিল বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও দর্শন প্রতিষ্ঠার নিরন্তর প্রয়াস বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।
১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগ সরকার পঁচাত্তরের পর জমা হওয়া সব জঞ্জাল বিদায় করতে পারেনি। ২০০৯-২০২১ সরকারে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ ও আরও সংহত হয়েছে। তার পরও আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগের অনেক ডাকসাইটে নেতা যাদের জীবদ্দশায় হয়তো সম্মান ও জনগণের ভালোবাসা পেয়েছেন, কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর বেশিরভাগকেই আওয়ামী লীগের ৯০ শতাংশ বর্তমানে সক্রিয় নেতাকর্মীরা চেনেন না বা জানেন না। বঙ্গবন্ধু পরিবার এবং শেখ হাসিনা ছাড়াও অন্য নেতাদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাজে উপস্থাপন করলে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে আরও শক্তিশালী ভিত্তি পেত এবং গণতন্ত্রের জন্য তা টেকসই হিসেবে বিবেচিত হতো।
বর্তমানে আওয়ামী রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিংহভাগ পিতৃপরিচয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতা। অন্যদিকে সুবিধাভোগী কর্মীদের একটি বড় অংশ জামায়াত-বিএনপি থেকে আসা 'ভাড়াটে' রাজনৈতিক কর্মী। এসব কর্মী আওয়ামী লীগের সুসময়ে অতীতেও ছিল বর্তমানেও আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে কখনও দুঃসময় এলে থাকবে না এটা বেশ বোধগম্য।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু তাতে জনগণের পাশাপাশি তৎকালীন অন্য দলগুলোর রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা অংশ নেয়নি? তারা কি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়নি?
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি যারা মুক্তিযুদ্ধের পরের অনেক প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, কিন্তু আওয়ামী রাজনীতির অংশীদার নয়, এমনকি পারিবারিকভাবেও তারা আওয়ামী ঘরানার নয়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে কভিডে বিপর্যস্ত পৃথিবীর এই ক্রান্তিলগ্নে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান স্তম্ভ 'গণতন্ত্র' আজও প্রত্যাশিত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারেনি। এটা সত্যিই বাংলাদেশের জনগণের জন্য গ্লানিকর।
এখন সর্বস্তরে দুর্নীতির চর্চা আর পেশিশক্তির ক্ষমতায়ন এবং আওয়ামী লীগের বিকল্প রাজনৈতিক উদারপন্থি দলের উত্থান সময়ের দাবি। যে বিপুল স্বাধীনতার চেতনাধারী কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন প্রায় ৬০ ভাগ তরুণ যারা বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়, তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া বর্তমান ও আগামীর সময়ের দাবি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু আওয়ামী লীগের 'মনোপলি' নয়। ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের বিকল্প সম্পূরক, সমান্তরাল, উদারপন্থি রাজনৈতিক ধারার পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের ছায়াতলে সব দল ও জনগণের ঐক্য পরিলক্ষিত হয়ে ছিল। ২০২৩ সালের নির্বাচন সামনে রেখে নতুনভাবে ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক পদযাত্রার নতুন একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নতুন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আরোহণ করলে দেশ গণতন্ত্রায়নের পথে এগিয়ে যাবে।
আমার বিশ্বাস, নতুন এ দল গঠনের প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন থাকলে জনগণ ও সুশীল সমাজের আস্থার বিকল্প কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবিসংবাদিত প্রতীক বঙ্গবন্ধুর আত্মাও শান্তি পাবে।
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন ও টক্সিকোলজি আর্মি মেডিকেল কলেজ বগুড়া