আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী তালেবানের আকস্মিক উত্থান-দখল আর সাধারণ আফগানদের দেশত্যাগের করুণ চিত্র এখন বিশ্ব গণমাধ্যমের অন্যতম প্রধান সংবাদ। গোটা দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির ওপরও এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পুনরুত্থানের যে বিরূপ প্রভাব পড়বে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সংবাদগুলো পড়ি আর কানে বেজে ওঠে বাংলাদেশের ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর দেওয়া সেই কুৎসিত স্লোগান- 'আমরা সবাই তালেবান/বাংলা হবে আফগান'। দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে এ স্লোগান দেওয়ার সাহস যে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীরা পেয়েছিল, বলাই বাহুল্য আমাদের নানা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দুর্বলতার দরুন, এই সাহস তাদের দিন দিন বেড়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যেমন এরা বিরোধিতা করেছিল, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশকে উগ্রবাদ আর সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অভয়ারণ্য তালেবানি আফগানিস্তান বানানোর বাসনায় নানা ষড়যন্ত্র চালিয়েছে এবং এখনও চালাচ্ছে। আমরা 'বাংলাভাই' নামক জঙ্গিদের উত্থান দেখেছি, হিযবুত তাহ্‌রীর, হরকাতুল জিহাদ, আনসার-আল-ইসলামসহ নানা ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠীর অপতৎপরতা দেখেছি এবং প্রতিদিন মানুষের মননে-মগজে সাম্প্রদায়িকতার চাষ দেখছি। মগজে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প কতখানি প্রকটরূপ ধারণ করেছে, তা বোঝা যায় বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেরই মনস্তত্ত্ব দেখে। বাংলাদেশে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নব্বই দশকে এমনকি একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকেও যে ধরনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ গড়ে উঠেছে, সে তুলনায় প্রতিরোধের কণ্ঠ দিন দিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। অথচ আমরা ভেবেছিলাম, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দরুন মানুষ যেহেতু এখন সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মধ্যেই থাকে, হয়তো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আরও জোরালো হবে, কিন্তু হয়েছে উল্টো। বরং সাম্প্রদায়িক অপশক্তিই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে গুজব ছড়িয়ে সন্ত্রাস চালায় এবং তাদের কোনো বিচারকাজ শেষ হয় না। তালেবানি যেন এখন বাংলাদেশকে গ্রাস করেছে, সাম্প্রতিক আফগানিস্তান ইস্যুতে এই চিত্র আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য মৌলবাদী শক্তিকে তোয়াজ করা এবং আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের কোনো বিচার না হওয়া।
তালেবানি মনস্তত্ত্বের যে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছি- আমার ধারণা, প্রতিটি শ্রেণি-পেশার সচেতন মানুষই কমবেশি এর শিকার হন বা প্রত্যক্ষ করেন। বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতায় এই মানসিকতার উত্থান ও বিস্তার নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই কাজ করবেন; কিন্তু একজন নাগরিক হিসেবে আমার মনে হয়, আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়াই এর একটি মূল কারণ। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, সব নাগরিকের আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার সমান। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে আইনের একচোখা নীতি আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখি। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ঝুমন দাস কোনো অপরাধ না করেও সাতবারেও জামিন পাননি; অথচ চলতি বছরের ১৭ মার্চ সেখানে চালানো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের মূল হোতাদের প্রায় প্রত্যেকেই এখন জামিনে। আমরা তো ভুলে যাইনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের রসরাজের কথা। নাগরিক হিসেবে আমাদের এমনটি লজ্জার যে, প্রায় ৯ বছর হয়ে গেলেও রামুর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে দায়েরকৃত ১৯টি মামলার একটিরও মীমাংসা হয়নি।
একেকটি সাম্প্রদায়িক হামলা আক্রান্ত মানুষের মনে যে দাগ ফেলে যায়, তা অমোচনীয়। ২০১২ সালে রামুর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের পর আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম আমরা। সেখানে এক শিশুর কথা আমি আজও ভুলতে পারি না। হামলার রাতে সারারাত একা ধানক্ষেতে লুকিয়ে থেকে দেখেছে আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে তার পাড়া, তার উপাসনার মন্দির। তার দৃষ্টিতে যে অনাস্থা, যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, তা কি কোনোদিন মুছে ফেলা যাবে? রাষ্ট্র এর কী প্রতিকার করেছে? ২০১৪ সালে যশোরের মালোপাড়ায় নৃশংস সাম্প্রদায়িক হামলার ক্ষেত্রে যদিও নির্বাচনোত্তর সহিংসতাকে ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, কিন্তু অন্য সব সাম্প্রদায়িক হামলার মতো এরও উদ্দেশ্য ছিল, সনাতন ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করে জায়গা-জমি দখল। ওই ঘটনার পর গ্রামের অধিকাংশই ঘরবাড়ি ফেলে রেখে প্রাণটি নিয়ে দেশত্যাগ করেন। কিন্তু ওই নৃশংস ঘটনার বিচার আজও হয়নি। বিচার হয়নি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী কিংবা ঠাকুরগাঁওয়ের গোপালপুর স্কুল মাঠের পাশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের। চলতি মাসের ৭ আগস্ট খুলনার রূপসার শিয়ালি গ্রামে যে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং তাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে মীমাংসা পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, তাতে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাদের দায়িত্ব কি অপরাধীর সঙ্গে মীমাংসা সারানোর নাকি তাকে আইনের আওতায় আনার?
এমন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের নজির দিয়ে শেষ করা যাবে না, অথচ বিচারের বেলায় লবডঙ্কা! এই বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের মনে সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদ। কেবল আইন প্রয়োগ করে এই বিষবাষ্প দমন করা সম্ভব না হলেও আইনের যথার্থ প্রয়োগ অপরাধীদের অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনে। কিন্তু সামাজিকভাবে এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে সমাজ-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস জরুরি। কোনো কোনো শিশুর মুখে আমরা এমন সাম্প্রদায়িক বক্তব্য শুনি, যা সে না বুঝেই বলে কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়, এটি তার পারিবারিক শিক্ষা। এ ব্যাধি নিয়েই শিশুরা শ্রেণিকক্ষে আসে, তার চোখে নানা ভেদনীতির পর্দা তৈরি হয়। কোনো কোনো শিক্ষকও এই সাম্প্রদায়িক বীজের গোড়ায় জল ঢালেন। সুতরাং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে- দু'ভাবেই একজন শিশুর মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠে।
আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, তালেবানের চেয়েও শক্তিশালী হলো তালেবানি মানসিকতা, যা একটি রাষ্ট্রকে দুমড়েমুচড়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক সমস্যার মোকাবিলা নিজ আদর্শ ও আইনের শক্তি দিয়েই করতে হয়। বাইরে থেকে কেউ এসে সমস্যা সমাধান করতে পারে না। গত দুই দশক ধরে আফগানিস্তানের যে চেহারা আমরা দেখেছি, তা ধূলিসাৎ হতে দু'দিন সময়ও লাগেনি। রাষ্ট্র প্রশাসনও তখন কোনো কাজে আসে না। এ জন্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতার আদর্শের ভিত্তিতে জনগণের মানসিকতা তৈরি করার কাজটিকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। তাহলেই প্রশাসন পিছুটান দিলেও জনগণ অপশক্তিকে মোকাবিলা করতে পারে। আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য সতর্কবার্তা। এখনও যদি আমাদের ঘুম না ভাঙে, তবে তা কালঘুম হতে বাধ্য।
লেখক, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী