
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঘুমিয়ে পড়ি। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র, দ্বিতীয় বর্ষে উঠব। থাকতাম কাঁঠালবাগান বাজার পার হয়ে ডান পাশের আগের প্রথম গলিটিতে একটি ভাড়া বাসায়। দুটি রুমের ঘর, এক রুমে আমি থাকতাম, আরেক রুমে অ্যাটমিক এনার্জিতে চাকরিরত দু'জন। সেদিন যথারীতি একটু শীত শীত ছিল, আমি হালকা একটি চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। আমাদের রান্নার জন্য ১২-১৩ বছরের একটি ছেলে ছিল। সে সকাল ৬টার দিকে উঠে যেত। সেদিন সকালে উঠে গেটের বাইরে গিয়ে শুনতে পায়, রেডিওতে সেনা কর্মকর্তারা কথা বলছেন। ফজরের নামাজ থেকে আসা কয়েকজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে রেডিওতে তাদের কথা শুনছেন।
সে উৎকণ্ঠা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এসে আমাকে ডাক দিয়ে বলে, ভাইয়া ভাইয়া ওঠেন, রেডিওতে মিলিটারিরা কথা বলছে। আমি জাগ্রত ছিলাম, চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে বললাম, রেডিওতে মিলিটারিরা কথা বলছে মানে? তা হলে তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মেরে ফেলেছে! দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে! এ কথা বলে আমি শোয়া থেকে উঠে পড়ি। পাশে আলনায় রাখা প্যান্ট-শার্ট পরে স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে গেটের বাইরে গেলাম। দূর থেকে দেখি গলির মোড়ের কোনার দোকানে একটি রেডিও বাজছে। কয়েকজন ফজরের নামাজ থেকে আসার সময় সেখানে বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে আছেন।
তখন সম্ভবত সকাল ৬টা ১৫ মিনিট। আমি গিয়ে শুনলাম, 'আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। সারা বিশ্বে কারফিউ দেওয়া হয়েছে। পরে আবার বলছে, সারাদেশে কারফিউ দেওয়া হয়েছে।' তার গলা বেশ কাঁপছে। বোঝা যাচ্ছে, কী হতে কী হয় সে আশঙ্কায় রয়েছে। আমার এক ক্লাসমেট ওই রাতে রেডিওতে ডিউটিতে ছিল। তার কাছে পরে শুনেছি, তাকেও সেদিন ডেকে তোলে অভ্যুত্থানকারী সেনা কর্মকর্তারা কীভাবে রেডিও স্টেশন চালু করবে, তা তাদের কাছে জেনে নেয় এবং যখন কথা বলছে, তখন তা শোনা যাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করে।
আমি রাস্তা দিয়ে সোজা পুবের দিকে পুরোনো রেললাইনের দিকে ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তায় দু-একজন করে লোকের সঙ্গে দেখা হলো। তারা তখনও জেনেছে বলে মনে হলো না। ফলে তাদের মধ্যে তেমন উৎকণ্ঠা দেখলাম না। আমি একটু এগিয়ে যাওয়ার পর একজন নিজ থেকে বলল, এইমাত্র এখান দিয়ে 'সন্ত্রাসী আওরঙ্গ' দেয়ালের ওপর দিয়ে টপকিয়ে ওই দিকে চলে গেছে। সাদামাটা সাধারণ পোশাকের লোকটিকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হলো। পুরোনো রেললাইনের দিকে ধীরে ধীরে যেতে থাকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে পুরোনো রেললাইনে পৌঁছে গেলাম। এটি ছিল মাটির রাস্তা, তারপর একটু এগিয়ে বর্তমান সোনারগাঁও হোটেলের দক্ষিণের দিকে ৩০-৪০ মিটার দূরে রেললাইনের রাস্তায় দাঁড়ালাম, যেখানে পরে সুন্দরবন হোটেল হয়েছে। সেখানে ২৫-৩০ জন লোক দাঁড়ানো ছিল, যাদের পাশে গিয়ে আমিও দাঁড়ালাম। দেখলাম খুবই দ্রুতগতিতে আর্মির কয়েকটি গাড়ি কোনোটা ক্যান্টনমেন্টের দিকে আবার কোনোটা শাহবাগের দিকে যাচ্ছে। তবে আমি যে কয়েক মিনিট সেখানে দাঁড়ানো ছিলাম, ওই সময় ক্যান্টনমেন্টের দিকে বেশি জিপ যেতে দেখলাম, সেনাবাহিনীর কোনো ট্রাক যেতে দেখলাম না। প্রায় ৫-৭ মিনিট পর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মি. বোস্টারের গাড়ি দেখলাম। স্বাভাবিক গতিতে গাড়িতে ফ্ল্যাগ উড়িয়ে শাহবাগের দিক থেকে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছে যানটি। তার গাড়ি দেখে আমি বিড়বিড় করে বললাম, ওই ব্যাটা বোস্টারই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করিয়েছে (এখন অবশ্য ভিন্ন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে যেখানে বলা হচ্ছে, তিনি হত্যার পক্ষপাতী ছিলেন না)। এ কথা শুনে কয়েকজন লোক আমার দিকে একটু মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু তারা কেউ কিছু বলল না। আমি এর কিছুদিন আগে আমেরিকান ফরেন পলিসির ওপর একটি বই পড়েছিলাম, সেখানে এ ধরনের কাজের প্রতি মার্কিন সরকারের নীতিগত সমর্থন ছিল বলে জানা যায়। তাছাড়া চিলির প্রেসিডেন্ট সালভেদর আলেন্দের হত্যার কথা এবং তার কিছুদিন পর ওই দেশের নোবেল বিজয়ী (১৯৭১) কবি পাবলো নেরুদার মৃত্যুর কথা মনে পড়ে।
কয়েক মিনিট সেখানে দাঁড়ানোর পর যখন পাল্টা আক্রমণের কোনো লক্ষণ দেখলাম না, তখন আমি আস্তে আস্তে বাংলামটর পার হয়ে শাহবাগের দিকে এগোতে থাকলাম। যতই এগোচ্ছি তখনও কোনো প্রতিরোধ বা কোনো পাল্টা আক্রমণের কোনো লক্ষণ দেখলাম না। রাস্তায় দু-একজন লোক দেখলাম। সামরিক বাহিনীর গাড়িও দু-একটা দেখলাম। আমি যেহেতু ১৯৭৪ সালে ঢাকায় এসে প্রথমে মিন্টো রোডের শেষ মাথায় একটি বাসায় থাকতাম, তাই আমি মন্ত্রীপাড়ার প্রায় বাড়িই চিনতাম। সেখান দিয়ে আমি প্রতিদিন হেঁটে রমনা পার্ক হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। প্রতিদিনের রিকশা ভাড়া দেওয়ার মতো অবস্থা তখন ছিল না। প্রতিটি বাড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে দেখতে যেতাম। অধিকাংশ বাড়িতে কে থাকতেন, বিশেষ করে নামকরা নেতারা কোন কোন বাড়িতে থাকতেন তা জানতাম। তাদের দেখার আগ্রহও নিজের মধ্যে ছিল। কোনো রকমের বাধা ছাড়াই আমি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ধরে মন্ত্রীপাড়া পার হয়ে বেইলি রোডের দিকে চললাম। পুরো মিন্টো রোডে একজন লোকেরও দেখা পেলাম না। কিন্তু আকাশে কিছু কাক ডাকাডাকি করতে শুনলাম। ঠিক যখন শেষ বাড়িটার কাছে পৌঁছলাম, বাঁ পাশ ধরে হাঁটছিলাম, তখন একজন দারোয়ান টাইপের লোক হঠাৎ আমার সামনে এসে বলল, 'আপনি এখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে যান, আর্মি এসে দেখলে আপনাকে মেরে ফেলবে। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ির সবাইকে মেরে ফেলেছে। তার দুটো ছেলে বাথরুমে থাকায় বেঁচে গেছে। এইমাত্র এখান দিয়ে বের হয়ে বেইলি রোডের দিকে চলে গেছে।' আমি তখন একটু ঘাবড়ে গেলাম।
তারপর সেদিক থেকে বের হয়ে রমনা থানার দিক দিয়ে আবার বাংলামটরের দিকে চলে এলাম। আবার সেখান দিয়ে কাঁঠালবাগানের রাস্তা ধরে (তখন পান্থপথের রাস্তা ছিল না, ৩০-৩৫ ফিটের গভীর ডোবা ছিল, যেখান দিয়ে নৌকা চলত)। আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। যেমন চিন্তা তেমনি আমি কলাবাগান হয়ে ভেতরের রাস্তা দিয়ে বর্তমান লাজফার্মার দিক দিয়ে রাসেল স্কয়ারের কোনায় দাঁড়ালাম, যেখানে আরও ১৫-১৬ জন কৌতূহলী লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ লক্ষ্য করলাম।
দু'মিনিট দাঁড়িয়ে দেখলাম, সোবহানবাগ মসজিদের দিক থেকে একটি কি দুটি মেশিনগানের মতো অস্ত্র নিয়ে আর্মির লোক সামরিক যানের ওপর বসে আছে। আবার বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে একটি প্রাইভেটকারের মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখা যাচ্ছিল। কয়েকজন সামরিক জওয়ান ভারী অস্ত্র নিয়ে ৩২ নম্বরের রাস্তায় পায়চারি করছে। হঠাৎ আমার মাথায় এলো, আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাব। এত কাছে দাঁড়িয়ে আছি, আমি ওই বাড়িতে যাবই। ফুটপাত থেকে নেমে দু'পা বাড়ানোর পর একজন লোক আমাকে পেছন থেকে ডাকল। বলল, এই ভাই, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আরেকটু এগোলে মিলিটারিরা তো আপনাকে গুলি করবে। তখন আমার সংবিৎ ফিরে এলো, তাই তো। আমরা যারা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তাদের কাউকে কিছু বলল না দূরে অবস্থানরত সামরিক বাহিনীর লোকেরা। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে এদিক থেকে ওদিকে পায়চারি করছিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কিছু সেনাসদস্য।
এখনও সেখান দিয়ে হাঁটি না, দু-একবার গিয়েছি, দারুণ অস্বস্তি বোধ করি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাস দুই-এক আগে বন্ধের একদিন বিকেল সাড়ে ৪টা কি ৫টায় হেঁটে যাচ্ছিলাম। দেখি একজন সেন্ট্রি একটি রাইফেল পাশে রেখে পা লম্বা করে সেন্ট্রি বক্সে ঘুমিয়ে আছে। অন্য আর কোনো নিরাপত্তা প্রহরী সেখানে দেখিনি। আমি আশ্চর্য হলাম, একজন রাষ্ট্রপতি বাড়িতে আছেন, তার বাড়ির নিরাপত্তার অবস্থা এত দুর্বল! এর বেশি তখন জানার বা বোঝার ক্ষমতা তখন আমার ছিল না। তবে মনটা খুব খারাপ লাগল। আমার তখন মনে হলো, চিলির আলেন্দেকে মেরে ফেলেছে, বঙ্গবন্ধুকে মারতে কতক্ষণ? তাছাড়া একাত্তর সালের পরাজিত শক্তি তো রয়েছেই। বহুমুখী শত্রু যেখানে তার রয়েছে, সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অধিকতর জোরদার করা জরুরি।
আমার বিয়ের ঘটক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রিসভার ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোল্লা জালাল উদ্দিনের প্রয়াত স্ত্রী। বিয়ের পর খালাম্মা আমাকে একদিন বললেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার এক সপ্তাহ আগে মোল্লা জালাল এক বিকেলে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে বললেন, দেশের অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না, তুমি সাবধানে থাকবে। বঙ্গবন্ধু হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, 'আরে জালাল! আমাকে কেউ মারতে আসবে না।' এমনটি তার উদারতারই প্রমাণ দেয়। কিন্তু তার উদারতা-ধারণা ঘাতকরা ভুল প্রমাণ করেছে। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট। সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক
মন্তব্য করুন