ইতিহাসের এক ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ১৭তম বার্ষিকী আগামীকাল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দেশজুড়ে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশের আয়োজন করে। ওই সমাবেশে গ্রেনেড হামলা আমাদের জাতীয় জীবনে এক মর্মন্তুদ ঘটনা। আন্তর্জাতিকভাবেও এ ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। সে সময় আওয়ামী লীগের জনসভায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের সময় প্রকাশ্য দিবালোকে যেভাবে গ্রেনেড হামলা হয়, তাতে নিরাপত্তা যে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু প্রশ্নবিদ্ধই নয়, বরং নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের যোগসাজশ ও পৃষ্ঠপোষকতা এখানে স্পষ্ট। একটি সরকার যখন নিজেই সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে কিংবা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা হয়, তার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, এরই এক দৃষ্টান্ত ২০০৪ সালের এই গ্রেনেড হামলা।
ওই দিনের নৃশংস হামলায় অলৌকিকভাবে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও দলটির তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও কয়েকশ আহত হন। ২০১৮ সালে দীর্ঘ ১৪ বছর পর ওই গ্রেনেড হামলার রায় প্রকাশ হয়। রায়ে আমরা দেখেছি 'রাষ্ট্রযন্ত্র' কীভাবে জড়িয়ে পড়ে। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালতও বলেছেন, 'রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের' সহায়তায় ওই হামলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে রাষ্ট্রের যোগসাজশ স্পষ্ট, সেখানে নিরাপত্তার বিষয়ে বলা বাহুল্য। আমরা দেখেছি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এতে স্পষ্ট, সে সময় নিরাপত্তার ভার যাদের ওপর ছিল- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, এনএসআই, ডিজিএফআইসহ কোনো প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন প্রধানরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। এমনকি এ ঘটনার পরও সে সরকার তদন্তের নামে 'জজ মিয়া নাটকের' অবতারণা করে, যা পরে একটি দুষ্টচক্রের ষড়যন্ত্র বলে প্রমাণিত হয়।
ব্যাপক তদন্তে প্রমাণিত হয়, ২১ আগস্টের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালায় হরকাতুল জিহাদের একদল জঙ্গি। ওই নৃশংস হামলায় দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন জড়িত ছিল। সংগঠনগুলো হচ্ছে- হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি), কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীন, লস্কর-ই তৈয়বা এবং এগুলো সবই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠী। তারা তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। ঘটনার সঙ্গে বিএনপি সরকারের তৎকালীন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, মুফতি হান্নান, কাশ্মীরের হিজবুল মুজাহিদীনের নেতা ইউসুফ ওরফে মাজেদ বাটসহ অনেকে যুক্ত ছিলেন। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া মুফতি হান্নানসহ জঙ্গিদের জবানবন্দিতে তা উঠে এসেছে। ২১ আগস্টের হামলাসহ জঙ্গিদের বিভিন্ন হামলায় কাশ্মীরি জঙ্গিদের জন্য পাকিস্তান থেকে আসা গ্রেনেডের একটি অংশ ব্যবহূত হয়েছে বলে তারা আদালতকে জানান।
লক্ষ্য করার বিষয়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের আগে ১ এপ্রিল দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়ে। দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটি ছিল এক ভয়াবহ ঘটনা। ভারতীয় বিদ্রোহী সংগঠন উলফা এ অস্ত্র চালানে জড়িত ছিল। সৌভাগ্যবশত অস্ত্র চালানকারীদের ভুল বোঝাবুঝিতে দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান তখন ধরা পড়ে। আমরা জানি না এর আগে এ রকম আরও কত অস্ত্র চালান হয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার মতো দশ ট্রাক অস্ত্রের চালানেও রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িত ছিল। জড়িত ছিল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর একটি অংশ। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে যেখানে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, সেই প্রতিবেশী দেশের বিদ্রোহী সংগঠন উলফা যেভাবে বাংলাদেশকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে, সেটি আমাদের দেশের জন্য কতটা নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তা সহজেই বোধগম্য। জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার কীভাবে জনগণেরই নিরাপত্তায় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে, দশ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনা এরই প্রমাণ।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে নিরাপত্তা বাহিনী রাজনৈতিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু দশ ট্রাক অস্ত্র ও ২১ আগস্টের হামলার ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, নিরাপত্তা বাহিনীর একটি অংশ ছিল 'বেপরোয়া'। তারা যেন সরকারের ভেতর আরেকটি সরকার। লোভ-লালসার কারণে তারা নিজেদের দায়িত্ব ভুলে গিয়েছিল। জনগণের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বে যারা থাকেন, তারাই যখন 'ষড়যন্ত্রে'র অংশ হয়ে ওঠেন, তখন গোটা দেশই হুমকিতে পড়ে। আমরা দেখেছি, ওই ভয়াবহ উভয় ঘটনায় সে সময়কার গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীগুলোর কতিপয় কর্তাব্যক্তিসহ তৎকালীন বিএনপি সরকারের মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারকরাও জড়িত ছিলেন। মূলত দশ ট্রাক অস্ত্র চালানের ধারাবাহিকতায়ই ঘটে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা, যে হামলার দুঃসহ ক্ষত এখনও অনেকে বয়ে বেড়াচ্ছেন।
ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের ব্যাপক বিস্তার আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সিরিয়া ও ইরাকে আইসিস ও আল কায়দা জঙ্গিদের হাতে ওই দুটি দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল। সেখানে পরাজয়ের পর আইসিস ও আল কায়দা ঘাঁটি গেড়েছে মিসর, লিবিয়া ও ইয়েমেনে। এদিকে পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়ায় আল সাবাব এবং মধ্য আফ্রিকার নাইজেরিয়া ও মালিতে বোকো হারাম জঙ্গিদের হাতে রাষ্ট্রগুলো ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। এশিয়ায় আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত হয়ে জঙ্গিবাদের ঢেউ বাংলাদেশেও আছড়ে পড়ে। এর চরম রূপ আমরা দেখেছিলাম ২০১৬ সালের ১ জুলাই ্তুহলি আর্টিসান' রেস্টুরেন্টে হামলার মাধ্যমে। সেই আক্রমণে আইসিস ভাবধারায় অনুপ্রাণিত নব্য জেএমবি নামে একটি সংগঠনের গুটি কয়েক সন্ত্রাসী দেশি-বিদেশিসহ ১৭ জন নিরপরাধ ব্যক্তিকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। এই অভিযানে দু'জন পুলিশ কর্মকর্তাও শহীদ হন। ওই বছরগুলোতে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (পরবর্তী সময়ে আনসার আল ইসলাম) নামে একটি জঙ্গি সংগঠন দেশের বিভিন্ন স্থানে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিধনে তৎপর হয়। সৌভাগ্যবশত সরকার অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জঙ্গিদের মোকাবিলা করে। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় একদিকে যেমন নিরাপত্তা বাহিনীকে সুসংগঠিত করা হয়, তেমনি দেশজুড়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা হয়। বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায় যেন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য ব্যাপক গণসচেতনতা চালানো হয়, যা আজ পর্যন্ত চলমান আছে।
অতি সম্প্রতি আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের সংবাদে আমাদের এখানে ধর্মজীবী কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে উৎসাহের আতিশহ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা হয়তো বাংলাদেশেও তালেবানের মতো জিহাদের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের দিবাস্বপ্টম্ন দেখছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ বিপুল মুসলিম সংখ্যাধিক্য হলেও মানুষ এখানে ধর্মপ্রাণ, ধর্মভীরু, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সরকার ও জনগণ একযোগে কাজ করে চলছে। ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলে তা দমনের ক্ষমতা সরকারের আছে এবং তার পেছনে জনগণের অটুট ও ঐকান্তিক সমর্থন আছে। বাংলাদেশকে তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর যারা স্বপ্টম্ন দেখছে, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে বলা যায়। ২১ আগস্টের বোমা হামলার বার্ষিকীতে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের নির্মূলে নতুনভাবে সচেতন হতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্নেষক ও অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর; ট্রেজারার, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক