
মোজাফ্ফর আহমদ (১৯২২-২০১৯)
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ উপমহাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা। ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেন কুমিল্লাতেই। ভিক্টোরিয়া কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে ইউনেস্কো থেকে ডিপ্লোমা করেন। কর্মজীবন শুরু শিক্ষকতা দিয়ে। বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করে পরে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। তবে এর ব্যাপ্তিকাল খুব কম (১৯৫২-১৯৫৪)। ১৯৩৭ সালে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হলেও ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপনা ছেড়ে পূর্ণভাবে যোগ দেন রাজনীতির ময়দানে। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিজ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রীকে ধরাশায়ী করে রাজনীতির ময়দানে এক নতুন প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। এর কিছুদিন পরই পড়েন আইয়ুব সরকারের রোষানলে। জারি হয় হুলিয়া। আত্মগোপনে কাটে দীর্ঘ আট বছর। ১৯৬৬ সালে আবার প্রকাশ্য রাজনীতির ময়দানে।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের জীবনে নতুন রাজনৈতিক অধ্যায় সূচিত হয় ১৯৬৭ সালে; ন্যাপ যখন বিভক্ত হয়ে পড়ে চীনপন্থি ও মস্কোপন্থি শিবিরে। চীনপন্থি ন্যাপের সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আর মস্কোপন্থি শিবিরের খান আবদুল ওয়ালী খান। এই শিবিরের পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি হন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। তিনি অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও। তখন থেকেই মস্কোপন্থি ন্যাপ মোজাফ্ফর ন্যাপ হিসেবে পরিচিত পায়। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের কারণে করেন কারাবরণ। একাত্তর পর্বে তিনি আরও সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে গঠিত সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের ছিলেন অন্যতম সদস্য। মুক্তিযুদ্ধকালে বামপন্থি মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন গড়ে তোলায় তার অবদান অবিস্মরণীয়। স্বাধীন বাংলাদেশে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৭৯ সালে। ১৯৮১ সালে বামপন্থি ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে। তারপর স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আবার হন কারারুদ্ধ।
রাজনৈতিক জীবনের বাঁকে বাঁকে সময় তাকে নির্ণয় করেছে ইতিহাসের স্বতন্ত্র আখ্যানরূপে। 'কুঁড়েঘরের মোজাফ্ফর'- এই পরিচিতও তাকে দিয়েছিল তার রাজনৈতিক জীবন অধ্যায়েই। বিস্তৃত রাজনৈতিক অধ্যায়ের পরতে পরতে তার দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক মননশীলতা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, নির্মোহ তাকে করে তোলে দৃষ্টান্তযোগ্য। সাংগঠনিকভাবে তার দলের রাজনৈতিক ব্যাপ্তি যা-ই থাকুক না কেন, তিনি অনন্য ছিলেন তার আদর্শের কারণে। সুবিধা তাকে বারবার হাতছানি দিয়েছে, কিন্তু প্রলুব্ধ হননি। ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট ৯৮ বছরে তার প্রয়াণ ঘটে। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে যখন পুরোপুরি রাজনীতিতে যোগ দেন, তখন তিনি ৩২ বছর বয়সের তেজি-সাহসী এক অবিচল রাজনৈতিক যোদ্ধা। সফলতা-ব্যর্থতার চিহ্ন মানুষের জীবনে আছে, থাকবেও। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদও এর ঊর্ধ্বে ছিলেন না। কিন্তু তিনি নমস্য এ কারণেই, জীবনের শেষ পর্যন্ত আদর্শচ্যুত হননি। আস্থা হারাননি বামপন্থায়। তার রাজনৈতিক জীবনের ট্র্যাজেডিও কম নয়। তিনি যাদের সঙ্গী করে রাজনীতি শুরু করেছিলেন, তাদের প্রায় সবাই একে একে তাকে ছেড়ে চলে গেলেও তিনি শেষ পর্যন্ত ছিলেন কুঁড়েঘরেরই বাসিন্দা।
'ধর্মকর্ম সমাজতন্ত্র'- ৭৫-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে তার এ স্লোগান রাজনীতির ময়দানে সমালোচনার খোরাক জোগালেও তিনি যে আদর্শের কথা বলতেন, তা আজও বামধারা এবং প্রগতিশীল দলগুলোর নীতিনির্ধারকরা নানা আঙ্গিকে ধরে রেখে রাজনীতি করছেন। রক্তস্নাত বাংলাদেশে তিনি প্রথম জাতীয় সরকার গঠনেরও দাবি উত্থাপন করেছিলেন। দেশের বহুধা বিভক্ত বাম রাজনীতির ক্ষয় ধরেছে অনেক আগেই। এর প্রেক্ষাপট কীভাবে তৈরি কিংবা এর কার্যকারণই বা কী- এসব নিয়ে নানা কথা থাকলেও অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ যে এ ভূখণ্ডের রাজনীতিতে পঞ্চাশের দশক থেকে অবিচ্ছেদ্য অংশ- এ সত্য এড়ানোর কোনো পথ নেই। শিক্ষকতার পর রাজনীতিই ছিল তার উপাস্য। তার রাজনীতি দেশ-জাতির কল্যাণে কতটা এসেছে, এ বিচার করবে মহাকাল। তার 'সমাজতন্ত্র কী এবং কেন'; 'প্রকৃত গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জানার কথা'; 'মাওবাদী সমাজতন্ত্র ও কিছু কথা' বাম রাজনীতির আদর্শ শিক্ষার অমূল্য গ্রন্থ। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতা পদক প্রত্যাখ্যান করে প্রমাণ করে গেছেন- ভোগের নয়, ত্যাগের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েই রাজনীতির ময়দানে তিনি পা রেখেছিলেন। আজ যখন পদ-পদবি, পদক, ক্ষমতা ইত্যাদি রাজনীতির বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে, তখন মনে পড়ে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের স্বাধীনতা পদক গ্রহণে অসম্মতি শুধু একটি দৃষ্টান্তই নয়; 'নগদ যা পাও হাত পেতে নাও'-এর যুগে গভীর বিশ্নেষণেরও দাবি রাখে। তার রাজনৈতিক আদর্শ নবরূপে, নবধারায় আবার জাগবে, না আরও ক্ষীয়মাণ হবে, তা নির্ভর করছে আজকের বামপন্থি রাজনীতির ধারক-বাহকদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মপন্থার ওপর। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক ও সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
মন্তব্য করুন