বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ অতিমারিতে বিপর্যস্ত দেশগুলো যে কোনো উপায়ে ভ্যাকসিন সংগ্রহে চেষ্টা করে যাচ্ছে। কয়েকটি কোম্পানি ভ্যাকসিন আবিস্কার করলেও ভ্যাকসিনগুলোতে মেধাস্বত্ব দাবি ও স্ব স্ব দেশের নানামুখী স্বার্থ সমুন্নত করার ফলে ভ্যাকসিন উৎপাদন ও বিতরণে নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। এ অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, সদস্য রাষ্ট্র এবং দাতব্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় কোভ্যাক্স গঠন করে এর মাধ্যমে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করছে এবং সেগুলো ন্যায্যমূল্যে, ক্ষেত্রবিশেষে বিনামূল্যে বা কম মূল্যে বিতরণ করছে। চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল এবং দেরিতে হলেও এ উপায়ে সংগৃহীত ভ্যাকসিন রাষ্ট্রগুলোর ২০ শতাংশ জনগণের কাছে পৌঁছাবে।

কোভ্যাক্স ও অন্যান্য মাধ্যমে ভ্যাকসিন সংগ্রহ রাষ্ট্রগুলোর জন্য সাময়িক স্বস্তি এনে দিলেও এটি কোনো দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই সমাধান নয়। যথাযথ সমাধানের লক্ষ্যেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মেধাস্বত্বের বাণিজ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলোর চুক্তি ১৯৯৪ (ট্রিপস)-এ বর্ণিত মেধাস্বত্বের সাময়িক মওকুফের সুযোগে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন, ওষুধ এবং অন্যান্য সামগ্রী স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও সরবরাহের মাধ্যমে অতিমারি মোকাবিলা করতে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের নেতৃত্বে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো ২০২০ সালের অক্টোবরে ডব্লিউটিওর ১৬৪ সদস্য সমন্বয়ে গঠিত ট্রিপস কাউন্সিলের কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করে। তারা যুক্তি দেখায়, এটি শুধু কভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরি করতেই সহায়তা করবে না, বরং যে দেশে উৎপাদনের অবকাঠামো আছে সে দেশে ওষুধ, তৎসম্পর্কিত প্রযুক্তি, চিকিৎসা পণ্যগুলো যেমন চিকিৎসা, ডায়াগনস্টিক টেস্ট এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরি করে অতিমারিটির সঙ্গে লড়াই করতে সহায়তা করবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং কানাডার মতো দেশ দাবি করে- তাদের উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে এবং তারা পেটেন্ট ছাড়ের সুযোগে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরি করতে আগ্রহী।

মওকুফ প্রস্তাবের পৃষ্ঠপোষকরা আশা করেন, ভ্যাকসিন এবং অন্যান্য চিকিৎসা প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত পেটেন্ট ও অন্যান্য মেধাস্বত্বের সাময়িক স্থগিতকরণ বর্তমানে প্রচলিত বাধ্যতামূলক লাইসেন্স বা সরকারি ব্যবহারের জন্য বিদ্যমান আইনানুগ আনুষ্ঠানিকতা হ্রাস করবে এবং ভ্যাকসিন উদ্ভাবনকারীদের আরও দ্রুত বাজারে প্রবেশ করতে সহায়তা করবে। তবে মেধাস্বত্বের সাময়িক মওকুফের প্রস্তাবে ভ্যাকসিন, ওষুধাদি এবং তৎসম্পর্কিত প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিজ্ঞান হস্তান্তর অন্তর্ভুক্ত কিনা; কোম্পানিগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান এবং কাঁচামাল ও পল্গাস্টিক ব্যাগ, ফিল্টার, ভ্যাকসিন উৎপাদনে ব্যবহূত কিছু মাধ্যমের মতো উপাদান সরবরাহ করা হবে কিনা, এ বিষয়গুলো নিশ্চিত নয়।

অন্যদিকে ফার্মা লবিগুলো যুক্তি দেয়, শুধু পেটেন্ট মওকুফ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে ভ্যাকসিন উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করবে না, যতক্ষণ না তারা লম্বা সময় এবং বিপুল বিনিয়োগ সাপেক্ষে নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে তোলে। অনেক দেশ ও ব্যক্তি মওকুফের এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন; তার মধ্যে বিল গেটস অন্যতম। তাদের মতে, নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতার অভাবে প্রযুক্তি হস্তান্তর এসব দেশের কোনো কাজে আসবে না। আর তাদের এ অবকাঠামো তৈরিতে দরকার উন্নত দেশগুলো থেকে অনুদান এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা। সুতরাং, পেটেন্ট মওকুফ করার পরিবর্তে তারা স্বেচ্ছায় লাইসেন্স, প্রযুক্তি হস্তান্তর ব্যবস্থা এবং কোভ্যাক্সের মাধ্যমে আরও বেশি ডোজ ভ্যাকসিন এ দেশগুলোতে সরবরাহ করার পরামর্শ দেয়।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দাবির মুখে স্বল্পমেয়াদি এ পেটেন্ট মওকুফ প্রস্তাবে বাইডেন প্রশাসনের সম্মতি মেলে। পরে প্রস্তাবটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের অনুসমর্থন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আলোচনার ইচ্ছা এ বিষয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করেছিল। ঐকমত্যের স্বার্থে প্রস্তাবকরাও তাদের ভ্যাকসিন, ওষুধ, ডায়াগনস্টিকস এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সম্পর্কিত মেধাসম্পদ মওকুফ প্রস্তাবটি সংশোধিত আকারে পেশ করতে সম্মত হয়। এ প্রস্তাবের পক্ষে একশটির বেশি দেশ পাশে থাকলেও এটিকে ট্রিপস কাউন্সিলের গত ৩০ এপ্রিল ২০২১ বা ৮-৯ জুন ২০২১ সভায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে পাস হতে হতো; কিন্তু দেশগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। এ সময় যুক্তরাজ্যসহ উন্নত দেশগুলো ভ্যাকসিনের উৎপাদন ও সরবরাহে ট্রিপস চুক্তির মধ্যে বিদ্যমান বাধ্যতামূলক লাইসেন্স, সমান্তরাল আমদানি, রাষ্ট্রীয় ব্যবহার বা গবেষণা ব্যতিক্রম এবং ওষুধে অন্তর্বর্তীকালীন পেটেন্ট না দেওয়ার মতো ছাড় অনুসরণ করতে উপদেশ দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় স্বল্পোন্নত দেশগুলো দাবি জানায়, তারা যতদিন উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ না করে, ততদিন পর্যন্ত এবং যারা শিগগিরই উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করবে তাদের ১২ বছর ওষুধের পেটেন্ট ছাড় দিতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২৯ জুন ট্রিপস কাউন্সিল স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওষুধের পেটেন্ট ছাড় ২০৩৪ সালের ১ জুলাই বা যতদিন তারা উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ না করে- এ দুটির মধ্যে যেটি আগে ঘটে ততদিন পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। তবে সদ্য উত্তীর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবির ক্ষেত্রে কিছু দেশ স্বল্প সময়ের জন্য ছাড় দিতে রাজি হলেও ট্রিপস কাউন্সিল এটিকে ট্রিপস চুক্তির ৬৬.১ অনুচ্ছেদের আওতাবহির্ভূত হিসেবে ডব্লিউটিওর জেনারেল কাউন্সিলে প্রেরণ করে।

এমতাবস্থায় নমনীয় শর্তে ভ্যাকসিন প্রযুক্তি, প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং কাঁচামাল স্থানান্তরের ব্যবস্থা ব্যতীত ওষুধের পেটেন্ট ছাড়ের ২০৩৪ সাল পর্যন্ত সময়সীমা বা কভিড-১৯ ভ্যাকসিনের স্বল্পমেয়াদি পেটেন্ট ছাড় বাংলাদেশের মতো দেশকে ট্রিপসের বিদ্যমান কাঠামোতে তাৎক্ষণিক সুবিধা এনে দেবে না। কারণ বাংলাদেশ বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ওষুধের পেটেন্ট দিতে বাধ্য নয়। তবে পেটেন্ট ছাড়ের সুযোগে অন্যান্য দেশের উৎপাদিত ভ্যাকসিন বাংলাদেশ সহজেই আমদানি করতে পারবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ২০২৬ সাল পর্যন্ত ভ্যাকসিনগুলোর অণু শনাক্তকরণ শেষে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় প্রটোকল মেনে জেনেরিক তৈরি করতে পারবে। এরপর উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হলে সদ্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশেষ সুবিধার অবর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশে জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে প্রণীত ওষুধের পেটেন্ট ছাড়ের ২০৩৪ সাল পর্যন্ত সময়সীমা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হবে না।

অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়