
ধরুন, দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল। দুটি দেশেরই সংবাদমাধ্যম সরকারের হয়ে জনসাধারণকে জানাল- তাদের জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। সামরিক খাতকে সব সরকারই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। শিক্ষার চেয়ে বহুগুণ ব্যয় তারা সামরিক খাতে করে। যদিও দুটি দেশেরই মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক শিশু ও যুবা। এদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। একটি দেশ আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল- যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ১৮-ঊর্ধ্ব সব শিক্ষার্থীকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তারাও যুদ্ধে অংশ নেবে। যে কোনো মূল্যে যুদ্ধ জয়ই লক্ষ্য। অন্যদিকে, প্রতিপক্ষ দেশ ঠিক করল- রাষ্ট্র সুরক্ষিত রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনী তাদের কাজ করবে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা অর্জন করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। তাদের বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। শত্রুরাষ্ট্র যুদ্ধনীতি ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। সে জন্য শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সবাইকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। ভূমিকা পালন করবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলাকার অধিবাসীরাও। কেননা, সমাজে শিক্ষাই আগে। যুদ্ধকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা নিশ্চয় ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু সেসব ঝুঁকি মোকাবিলা করা অসম্ভব নয়। তারা জিজ্ঞেস করল, যুদ্ধাবস্থায় বাড়িও ঝুঁকিমুক্ত কি? তা ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছে বাড়ির মতোই বটে। শিক্ষক, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব, পাঠাগার, উন্মুক্ত পরিসর ইত্যাদির সাহচর্য বাড়ির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়; ক্ষেত্রবিশেষ বেশি। তারা বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদের মতামত উদ্ধৃত করে বলল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো কেবল লেখাপড়া করার স্থান নয়। সামাজিক সম্প্রীতি, পারস্পরিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার উপযুক্ত পরিসরের নামই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বার্নার্ড শ বলেছিলেন, কেউ কাউকে কিছু শেখাতে পারে না; উপযুক্ত পরিবেশে মানুষ নিজের শিক্ষা নিজেই অর্জন করে। অতএব, সিদ্ধান্ত হলো- তারা বহিঃশত্রুও মোকাবিলা করবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খোলা রাখবে। যুদ্ধটা তারা কেবল একমুখী পদ্ধতিতে করবে না।
দুই দেশই ধরে নিল- যুদ্ধ খুব বেশিদিন করতে হবে না। কিন্তু যুদ্ধ বছরের পর বছর চলতে থাকল। দুই দেশেরই শক্তিশালী অস্ত্র উৎপাদক বন্ধুরাষ্ট্রগুলো তাদের কাছে যুদ্ধাস্ত্র শুধু বিক্রিই করল না; উপহারও পাঠাতে থাকল লটের পর লট। সঙ্গে মানবিক সাহায্যও আসতে থাকল। কিন্তু যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে গিয়ে দুই দেশেরই অর্থনীতি দুর্বল হতে থাকল। দারিদ্র্য বাড়তে থাকল। এর পরও যুদ্ধ ও শিক্ষা কার্যক্রম সমান্তরালভাবে চালিয়ে যাওয়া দেশটির শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট বয়সে তাদের শিক্ষাপর্ব সম্পন্ন করতে পারল। তাদের কেউ কেউ সামরিক বাহিনীতে যোগ দিল। কেউ কেউ পৃথিবীর কোথাও কেউ যেন যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচারণা শুরু করল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা শুরু করলেও সরাসরি আলাপ-আলোচনার আয়োজনও তারা করল। অন্যদিকে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পূূর্ণ বন্ধ রাখা দেশের নতুন প্রজন্ম জয়ী না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করে যাওয়ার অঙ্গীকার প্রকাশ করল। যুদ্ধাপরাধেও জড়িয়ে গেল তাদের অনেকে।
উল্লিখিত কোন দেশের সিদ্ধান্ত উপযুক্ত ছিল বলে আপনি মনে করেন?
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যুদ্ধের ক্ষতি এক সময় পুষিয়ে নেওয়া যায়; শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া মোটেই সহজ নয়। অনেক সময় তা অসম্ভব। বাংলাদেশের শিক্ষার বাস্তব সমস্যা আমরা কমবেশি অবগত। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সুষম রূপ লাভ করেনি। শিক্ষানীতিকে আমরা যত্ন করে বস্তাবন্দি রেখেছি। এর মধ্যে করোনার বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ (!) ঘোষণা করতে হয়েছে। এই মেটাফরিক্যাল যুদ্ধাবস্থায় শিল্প-কারখানা চালু আছে। যোগাযোগও নানা উপায়ে চালু আছে। হাটবাজার তো আছেই। সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব বন্ধ হয়নি। বন্ধ শুধু শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে আছে। তারা টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘটিত দুর্নীতির খবর দেখছে; কিশোর গ্যাংগুলোর ভয়াবহতা দেখছে। ধর্ষণের বিচার না হওয়া; নাস্তিক সন্দেহে যে কোনো ব্যক্তিকে পুড়িয়ে মারা; সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া; রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ব্যক্তির নামে কুৎসা রটানো; বিনা বিচারে যে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারা; সমাজের ছবি ইত্যাদি দেখতে দেখতে তারা নেতিবাচকতার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হচ্ছে। তারা এও দেখছে, সূর্য উঠছে এবং সূর্য ডুবছে। ঘরে বসে একটা ভালো খবরও তারা পাচ্ছে না। অভিভাবকরা বাইরে যাচ্ছেন। ভিড়ের মধ্যে বহুবিধ স্পর্শ নিচ্ছেন, বাড়িতে এসে সন্তানদের স্পর্শ করছেন।
হাজার হাজার বেসরকারি শিক্ষকের পরিবার লজ্জায় না খেয়ে থাকার কথা প্রকাশ করতে পারছে না। অনলাইন ক্লাস নামক খেলায় অংশগ্রহণ করার সংগতি কোটি শিক্ষার্থীর নেই। অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও নেই। তথাকথিত নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনলাইন ক্লাস নামক প্রহসনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা প্রতি মাসে বেতন না দিলে অনলাইন গ্রুপ থেকে বহিস্কৃত হওয়ার হুমকি পাচ্ছে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকৃত ও কলুষিত হচ্ছে। বেঁচে থাকাটাই নাকি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মরণশীল মানুষের জন্য- তা সে কীটের মতো জীবন হলেও! কী আসে যায়? সূর্য উঠছে, সূর্য ডুবছে। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ কি শেষ হবে? যদি হয়, তারপর বিপর্যস্ত শিক্ষায় কীভাবে আবার সবাই ফিরবে? আর যদি না হয়, যদি নানা ভাইরাসের সঙ্গে অব্যাহতভাবে লড়াই করেই মানব জাতিকে টিকতে হয় বলে মেনে নিতে হয়; তাহলে আমরা কী করব? আমরা কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখব না? প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীকে সংকট থেকে উদ্ধার করার কাজও কিন্তু যুদ্ধই এক প্রকার। আপনারাই বলুন, কোন যুদ্ধ অগ্রাধিকার পাবে- মানুষ গড়ার, নাকি অদৃশ্য শত্রু মোকাবিলা করার নামে প্রজন্ম ধ্বংস করার?
কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক
মন্তব্য করুন