রসিক বাঙালি শিক্ষিতজন সৈয়দ মুজতবা আলীর 'দেশে বিদেশে' বইটি পড়েননি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আফগানিস্তান, আফগান জাতি, কাবুল এবং কাবুলের উপকণ্ঠ নিয়ে এমন সরস রচনা আমরা আর পড়িনি। অনেক বছর ধরে আফগানিস্তানের ক্ষমতার রদবদল দেখছি। কিন্তু আফগান জাতির এমন ঘটনাবহুল বিশ্নেষণ আমি অন্তত পড়ার সুযোগ পাইনি। মুজতবা আলীর গদ্য সুখপাঠ্য। তরতরিয়ে এগিয়ে যায় ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ-রসিকতাসহ। বাদশাহ আমানউল্লাহর শাসনামলে শেষ অধ্যায়ে বাচ্চাই সাকাও নামে একজন ডাকাতের নেতৃত্বে কাবুল দখল হয়। বাদশাহ আমানউল্লাহ পালিয়ে যান কান্দাহারে এবং পরে তিনি আর তার বড় ভাই মইনুল সুলতানও আত্মসমর্পণ করেন। অথচ এই বাদশাহ আমানউল্লাহ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন; একটা আধুনিক আফগানিস্তান করার চেষ্টাও করেছিলেন। মুষ্টিমেয় লোক নিয়ে বাচ্চাই সাকাওয়ের ডাকাত বাহিনী কাবুল দখল করে নিল। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায়, "বাচ্চায়ে সাকাওয়ে রাজমুকুট পরল। মোল্লারা আশীর্বাদ করলেন। পরদিন ফরমান বেরোল। তার মূল বক্তব্য- আমানউল্লাহ কাফির, কারণ সে ছেলেদের অ্যালজেবরা শেখাত, ভূগোল পড়াত। বলত, পৃথিবী গোল। বিংশ শতাব্দীতে এ রকম ফরমান বেরোতে পারে সে কথা কেউ সহজে বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু বাচ্চার মতো ডাকাত যখন তখন আসীন হতে পারে, তখন এ রকম ফরমান আর অবিশ্বাস করার কোনো উপায় থাকে না। শুধু তাই নয়, ফরমানের তলায় মোল্লাদের সই ছাড়াও দেখতে পেলুম সই রয়েছে আমানউল্লাহর মন্ত্রীদের। বাচ্চা তার ফরমানে আমানউল্লাহ যে কাফির সে কথা প্রমাণ করে বলেছে এবং যেসব দেশি-বিদেশি মাস্টার-প্রফেসর আমানউল্লাহকে এসব কর্মে সাহায্য করত তাদের ডিসমিস করা হলো; স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হলো।" এসব ঘটনাপ্রবাহ প্রায় একশ বছর আগের। সৈয়দ মুজতবা আলী আফগানিস্তানের শিক্ষকতার চাকরি হারালেন। শীতে অনাহারে যখন মৃতপ্রায় তখন তার ছাত্র বাচ্চাই সাকাওয়ের উনিশ বছর বয়সী কর্নেল প্রচুর খাবার দিয়ে যায়। এ সময় নানাভাবে আমানউল্লাহর মন্ত্রীদের বাড়ি লুট করা হচ্ছিল। তারও একটা চমৎকার অথচ নিষ্ঠুর বর্ণনা আছে। পাঠক হয়তো বইটি আবার পড়ে দেখবেন। তবে তখন আমেরিকা-রাশিয়ার ব্যাপক অংশগ্রহণের কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু পাওয়া যায় একজন বন্ধু যে উৎসবে, ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে এবং শ্মশানে যে কাঁধ দিয়ে থাকে সেই আবদুর রহমানকে। সরল হৃদয় এই আবদুর রহমানকে আজও হয়তো আফগানিস্তানে খুঁজে পাওয়া যাবে।

এখনও হয়তো ঠিক একটা দেশের অধিকাংশ মানুষই আবদুর রহমান। সেদিন যেমন সৈয়দ মুজতবা আলী ব্রিটিশরাজের কল্যাণে একটি প্লেনে অনেক কষ্টে ভারতে ফিরে আসেন, তেমনি কয়েক দিনের সংবাদে কাবুল এয়ারপোর্টে সেই ভয়ার্ত জনতা যারা আজকের ভয়ংকর, অনিরাপদ কাবুল ত্যাগ করার জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিয়ে ফেলেছেন। পাঁচজনের মৃত্যু এবং বহু আহতের সংবাদ পাওয়া গেছে। সেই যে আধুনিক শিক্ষার স্কুলগুলো, সেগুলো বাচ্চা সাকাওয়ের রাজত্বের দ্বার কবে খুলেছিল? হ্যাঁ, খুলেছিল বটে, কিন্তু বন্ধও হয়েছে বহুবার। সম্প্রতি সেই আধুনিক শিক্ষার প্রসারও হয়েছিল অনেক। চলচ্চিত্র, সংগীত, আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের লোকসংগীতের চর্চা একটা আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে গিয়েছিল। আফগান নারী চলচ্চিত্র পরিচালকের সিনেমা ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত হয়েছিল। তারা কেমন আছেন? সে সময়ের লৌহপ্রাচীর পেরিয়ে কিছু সংবাদ হয়তো আমরা পাচ্ছি, কিন্তু বেশিদিন পাব বলে প্রত্যয় হয় না। আফগান জাতি বহু শতাব্দী ধরে আমাদের ইতিহাসের সঙ্গী হয়েছে। সেই বাবরের ভারত দখলের সময় আফগান সৈনিকরা তার সঙ্গে পানিপথ জয় করে দিল্লি এসেছিল। আবার হুমায়ুনকে পরাজিত করে শের-ই-আফগান শেরশাহ দিল্লি অধিকার করে অনেক বড় জনকল্যাণমূলক কাজ করে গেছেন। বহু আফগান সেনাপতির জায়গা হয়েছিল মোগল দরবারে। সেই থেকে আফগান সেনাপতিরা ঢাকা, মুর্শিদাবাদের রাজশক্তির সঙ্গে থেকেছে। কখনও আনুগত্য, কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বস্ত সেনাপতি বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরও আফগান। একবিংশ শতাব্দীতে যখন স্যাটেলাইট, ইন্টারনেটের প্রবল প্রভাব আজকের পৃথিবীতে, তখন গুহাবাসীর অবিজ্ঞান, অযৌক্তিক তত্ত্ব দিয়ে দেশ শাসন করছে তালেবান। শক্তি নাঙ্গা তলোয়ার নয়, আধুনিক অস্ত্র। এই আধুনিকতার শক্তি নিয়ে এগিয়ে চলেছে তারা। মহাপরাক্রমশালী রুশ-মার্কিন পরাজিত হয়ে চলে গেল। কোনো প্রগতিশীল নতুন শক্তি এলো না। কিন্তু ১৯৭১ সালে এই কাবুল হয়েই পাকিস্তানে আটকে যাওয়া সেনাবাহিনীর লোকরা ভারতে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ১৯৭২ সালেও অনেকে কাবুল এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কাবুল সরকার তাদের আতিথেয়তা দিয়ে নানাভাবে সাহায্য করে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কাবুল হয়েই অনেক ভারতীয় বিপ্লবী রাশিয়ার পথ ধরেছেন। স্বয়ং নেতাজি কাবুলের পথ ধরেই পশ্চিমে গিয়েছিলেন।

ফিরে আসি শিল্প-সাহিত্যের কাছে। শিল্প-সাহিত্যের নিয়তি কি সেই সৈয়দ মুজতবা আলী, যেখানে শিক্ষতা করতেন সেই মকতব-ই-হাবিবিয়ার মতো হবে? বাচ্চা-ই-আক্রমণের প্রথম ধাক্কায় মকতবটা দখল করে টেবিল-চেয়ার-বই-ম্যাপ পুড়িয়ে দিয়েছিল। সব দখলদার সেনাবাহিনীই এ কাজটি করে। আমেরিকান সৈন্যরাও পৃথিবী অন্যতম শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরি বলে পরিচিত ইরাকের লাইব্রেরি পুড়িয়ে দিয়েছিল। কত জ্ঞান-বিজ্ঞান যে এভাবে ধ্বংস হয়! আফগানিস্তানে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বুদ্ধের ভাস্কর্যকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আরও কত অজানা ভান্ডার নিক্ষিপ্ত হয়েছে অন্ধত্বের রোষানলে! নারী চলচ্চিত্রকারও কি পাঁচ হাজার বছর আগে ব্যাবিলনের প্রস্তরগাত্রে উৎকীর্ণ কবিতার মতো জীবনযাপন করবেন? 'ফর মেন মাস্ট ওয়ার্ক/ অ্যান্ড উইমেন মাস্ট উইপ'।

যেখানে কোনো যুক্তি নেই, তর্ক নেই; ন্যায়-অন্যায় নেই। মেয়েদের কর্মই হচ্ছে পুরুষের অকাট মূর্খতার জন্য চোখের পানি ফেলে খেসারতি দেওয়া। যুগ যুগ ধরে আফগান নারীরা কি তাই করে আসছে? নারী বোরকা পরবে, এখন হিজাব পরবে। কিন্তু কোথাও বেরুতে হলে একজন পুরুষ সঙ্গে থাকতে হবে। বিদ্যালয়ে যেতে হলে ওই রকম পুরুষ কোথায় পাওয়া যাবে? অবরুদ্ধ এবং নানা কালাকানুনের বেড়াজাল পেরিয়ে আফগান ক্রিকেট দল রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তাদেরই বা কী হবে? এদিকে আমাদের দেশের মক্তব-মাদ্রাসায় পড়া বেকার যুবকরা তালেবান শাসনের সময় আফগানমুখী হয়েছিল। ফিরে এসে নানা ধরনের জঙ্গি কর্মকাণ্ডে যুক্তও হয়েছিল। এবারও কি তারা আফগানমুখী হবে? পুলিশ প্রশাসন ইতোমধ্যে এ শঙ্কা প্রকাশ করেছে। আমাদের এ দেশের রাজনীতি সংস্কৃতিমুখী। বড় বড় ঐতিহাসিক আন্দোলন এবং তার বিজয়ের প্রেক্ষাপটে আছে সংস্কৃতি। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে শুরু করে আজকের শিল্প-সাহিত্য তার প্রেরণা। কিন্তু রাজনীতির মধ্যেও ঘাপটি মেরে বসে আছে তালেবান সংস্কৃতি। গ্রামবাংলা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি সচিবালয় পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে হিজাব-বোরকার সংস্কৃতি। দেশে যেভাবে নারীর ক্ষতায়ন হয়েছে, তাকে অবজ্ঞা-অবহেলা করে আমাদের নারীরাও কি ওই অন্ধকার যুগে পা বাড়াবে? বাঙালি নারীরা কি বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানীর পথ ধরবে? আফগান নারী চলচ্চিত্র পরিচালকের হাহাকারে আমাদের হৃদয়ও বিদীর্ণ হয়েছে। তার সৃজনের পথ যেন অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে আসে। প্রতিবেশী ইরানের দৃষ্টান্ত যেন আফগান শাসকরা গ্রহণ করে। সেখানেও ইসলামী বিপ্লব হয়েছে কিন্তু চলচ্চিত্রকারদের সুযোগ বন্ধ হয়নি। বিশ্বের আধুনিক চলচ্চিত্র ও নাটকের কেন্দ্র এখন ইরান। যদিও চলচ্চিত্রকার ও নাট্যকর্মীরা প্রায়ই নানা ধরনের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, তবুও চর্চা তো চলছেই।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব