বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশের শিশুরা জলবায়ু সংকটজনিত বিরূপ প্রভাবের শিকার হওয়ার 'চরম ঝুঁকিতে' রয়েছে- জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ প্রকাশিত প্রতিবেদনের এ ভাষ্য উদ্বেগজনক হলেও বিস্ময়কর নয়। আমরা জানি, যে কোনো দুর্যোগেই শিশু ও নারীরা সর্বাধিক দুর্ভোগের শিকার হয়। আর জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সর্বব্যাপ্ত দুর্যোগে শিশুরাই যে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে থাকবে, তা দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা। আমাদের মনে আছে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত ইউনিসেফের অপর এক প্রতিবেদনে একই আশঙ্কাজনক চিত্র ফুটে উঠেছিল। গত দুই বছরে পরিস্থিতির যে আরও অবনতি ঘটেছে, আলোচ্য প্রতিবেদনে তা স্পষ্ট। বাড়তি উদ্বেগের বিষয় এই যে, প্রতিবেদনটি এমন সময় প্রকাশ হলো, যখন বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী চলছে করোনা দুর্যোগ। আমরা দেখছি, ইতোমধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এই বৈশ্বিক মহামারির যে প্রভাব, তাতে শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এই বিবর্ণ চিত্রের বার্তা বাড়তি সতর্কতা ও সচেতনতারই তাগিদ দেয়। এর সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টিও বিবেচনাযোগ্য। আফগানিস্তানের সামনে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ছাড়াও গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলের অপর দুই দেশ ভারত ও নেপালে দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। তাতে এ অঞ্চলের শিশুদের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে, তা থেকে বাংলাদেশ মুখ ফিরিয়ে বসে থাকতে পারে না।

কারণ ভৌগোলিকভাবে ঘনিষ্ঠ দক্ষিণ এশিায় যে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপর দেশকে স্পর্শ করা স্বাভাবিক। এ ছাড়াও খোদ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় ইতোমধ্যে দৃশ্যমান নানা চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে শিশুর জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচ্য প্রতিবেদনের ভাষ্য 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' বললে অত্যুক্তি হয় না। আমরা জানি, বৈশ্বিক এই দুর্যোগে আক্রান্ত দেশগুলোর প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। স্বীকার করতে হবে, আবহমান কাল থেকেই আমরা বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে টিকে রয়েছি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সর্বব্যাপ্ত দুর্যোগে শুধু অভিজ্ঞতা ও অভিযোজন ক্ষমতা সম্বল করে সুরক্ষা পাওয়া কঠিন। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিপুল অর্থায়নও যে প্রয়োজন- গত এক দশকে আন্তর্জাতিকভাবে তা প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে নিজস্ব উৎস থেকে সে অর্থের জোগান দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তারপরও আমরা যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় নীতিগত প্রস্তুতি নিয়েছি; যেভাবে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রেখেছি, তা অনেক উন্নত দেশও পারেনি।

কিন্তু ইউনিসেফের এ প্রতিবেদন প্রমাণ করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কতটা বিস্তৃত এবং তা মোকাবিলায় আরও কতটা পথ যেতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, এ প্রতিবেদন নীতিনির্ধারকদের নতুন করে চিন্তাভাবনার সুযোগ তৈরি করে দেবে। মনে রাখা জরুরি, শিশুদের ওপর যে অভিঘাত, সেটাকে আর দশটা অভিঘাতের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার অবকাশ নেই। এও ভুলে যাওয়া চলবে না- আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। একটি জাতির শৈশব যদি সুরক্ষিত থাকে, তাহলে সুরক্ষিত থাকে জাতীয় জীবনের পরবর্তী ধাপগুলোও। কন্যাশিশুদের কথা বিশেষভাবে ভাবতে হবে। করোনা পরিস্থিতিতে আমরা দেখছি, বাল্যবিয়ের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে শিশুরা যখন নাজুক থাকে, কন্যাশিশুর পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়। শিশুর জন্য খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ঝুঁকি অনেক ক্ষেত্রে কন্যাশিশুর জন্য বাল্যবিয়েতে রূপান্তর হয়।

আমরা প্রত্যাশা করি, আলোচ্য প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে শিশুদের সুরক্ষায় নীতিগত ও কারিগরি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বকেও যে দায় নিতে হবে- সে কথা আমরা আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কিছু দেশের বেপরোয়া শিল্পায়ন ও বিসবুজীকরণের কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে বলেই আমাদের শিশুরা আজ এমন ঝুঁকির মুখে। আর সবাই মিলে যদি সমন্বিতভাবে কাজ করা যায়, তাহলে শিশুদের ভবিষ্যতে দেখা দেওয়া বিবর্ণ রেখা সম্ভাবনার রংধনুতে পরিবর্তন করা কঠিন হতে পারে না।