
আজ ৩০ আগস্ট ২০২১। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ আবির্ভাব দিবস। ঈশ্বর আছেন। তিনি স্বয়ম্ভু। সর্বভূতে তিনি বিরাজমান। তিনি এক ও অদ্বিতীয় এবং নিরাকার। আবার সাকার রূপ ধারণ করেও তিনি আবির্ভূত হন। অব্যক্ত স্বরূপে যিনি অবতারী, ব্যক্ত স্বরূপে তিনি অবতার। জীবের মঙ্গলের জন্য নরদেহ ধারণ করে তিনি যুগে যুগে অবতীর্ণ হন। ধর্মের মাত্রা যখন কমে যায়, অধর্মের মাত্রা তখন বৃদ্ধি পায়। মানুষ সত্যভ্রষ্ট হয়ে অসৎ পথে ধাবিত হয়। তখন স্বয়ং ভগবান মানবরূপে জন্মগ্রহণ করে অবতার হিসেবে আবির্ভূত হন। শ্রীগীতায় তাই স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- 'যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানিভর্বতি ভারত।/অভ্যুত্থানমর্মস্য তদাত্ননং সৃজাম্যহম্।/পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুস্কৃতাম্।/ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে।'
ধর্মের গ্লানি কী? মানুষ মানবীয় গুণাবলি ভুলে গিয়ে মনুষ্যত্বের অবমাননা করে। কামনা-বাসনা ও দুর্দান্ত লোভের বশবর্তী হয়ে জড়বাদের দিকে ছুটে চলে। হিংসার আস্ম্ফালন ও প্রবৃত্তির প্রাবল্যে দিজ্ঞ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অধর্মের পথ বেছে নেয়। ধর্মের পতন হয় এবং পাপের প্রাদুর্ভাব হয়। তখনই স্বয়ং ভগবান যুগে যুগে সাধু সজ্জন ব্যক্তিগণকে পরিত্রাণ করতে অবতার রূপে ধরাধামে নেমে আসেন। আবার মানুষকে ধর্মপথে ধাবিত করেন। মানবজাতিকে অনিবার্য ধ্বংস থেকে রক্ষা করেন। পাপীদের শাস্তি দিতে অধর্মকে বিনাশ করতে স্বয়ং ভগবান ধরাধামে মানুষরূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাই স্বয়ং ভগবান ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র রূপে, দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণ রূপে এবং কলিযুগে শ্রীগৌরাঙ্গ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ভগবান ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে হুগলি জেলায় কামার পুকুর গ্রামে আবির্ভূত হন। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব জীব উদ্ধারের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। হরিপুরুষতত্ত্ব অনুযায়ী 'অনাদি আদি গোবিন্দ স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ও শ্রীগোবিন্দ এ দুয়ের লীলার সর্বসমষ্টি শক্তি যিনি তিনিই শ্রীশ্রী প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দর'। শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর তিরোধানের তিনশ বছর পর ১৮৭১ সালের ২৮ এপ্রিল প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরও এ ধরাধামে অবতীর্ণ হন। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনই ছিল অবতারগণের আবির্ভাবের প্রধান লক্ষ্য। এভাবে হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধান মতে, যুগে যুগে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নরদেহ ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন। অনেক ধর্মতাত্ত্বিকের মতে, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল যিশুখ্রিষ্টের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে। আবার সুদূর অতীতে গ্রিক, চীন, মিসর প্রভৃতি সভ্যতার নিদর্শন থেকে জানা যায়, মহাকবি হোমারের জন্ম হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে।
ঋষি বঙ্কিম চন্দ্রের মতে, যিশুখ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ১৬০০ বছর পূর্বে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল। তাই আমরা মোটামুটিভাবে আজ থেকে ৫০০০ বছর পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে মনে করি। মথুরার রাজা ঘোর পাপী এবং অত্যাচারী ছিল। তার অত্যাচারে পৃথিবী জর্জরিত হয়ে পড়ল। দেবগণ বৈকুণ্ঠে বিষুষ্ণর নিকট গেলেন। বিষুষ্ণ গোকুল নগরে দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে কংসকে বধ করবেন বলে জানালেন। নারদ মুন সংবাদটি জানতে পেয়ে মথুরার রাজা কংসকে জানিয়ে দিলেন, তার ভগিনীর অষ্টম গর্ভের সন্তান তাকে বধ করবে। কংসরাজ অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দেবকী ও বসুদেবকে রাজধানীতে আনয়ন করলেন। উভয়কেই কারাগারে আবদ্ধ করে রাখলেন। চারদিকে পাহারা মোতায়েন করা হলো। কংসের হাতে একে একে দেবকীর সাতটি সন্তান বধ হওয়ার পর অষ্টম গর্ভে শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করলেন। কংসের ভয়ে বসুদেব পুত্রের জন্মের অব্যবহতি পরই সকলের আলক্ষ্যে গোকুলে তাকে যশোদার নিকট রেখে আসলেন। যশোদার সদ্যোজাত কন্যাকে এনে দেবকীকে দিলেন। কংস সংবাদ পেয়ে দেবকীর সন্তানকে হত্যা করার ইচ্ছায় ওই মেয়েটিকে মারতে উদ্যত হওয়া মাত্র, মেয়েটি নিমিষে অদৃশ্য হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল। কংসকে জানিয়ে গেল, তাকে বধ করার জন্য স্বয়ং নারায়ণ জন্মগ্রহণ করেছেন।
নন্দ ও তার পত্নী যশোদার গৃহে শ্রীকৃষ্ণ লালিত-পালিত ও বর্ধিত হতে লাগলেন। তারা শ্রীকৃষ্ণকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। শৈশবকালে কৃষ্ণ অন্যান্য গোপবালকের সঙ্গে ধেনু চরাতেন। এদিকে কংস নারায়ণরূপে শিশুকে বিনাশ করার জন্য পুতনা, তৃণাবর্ত, অরিষ্ট প্রভৃতি অসুরদিগকে পাঠাল; সকলেই কৃষ্ণের হাতে নিহত হয়। বাল্যকালেই শ্রীকৃষ্ণের ভেতর অলৌকিক ভগবৎশক্তির বিকাশ লাভ ঘটে। তিনি কালিয়ানাগ দমন করে কালিন্দির জলকে নিরাপদ গোবর্ধন গিরিধারণ পূর্বক তার অসীম ক্ষমতার প্রভাব প্রদর্শন করেন। দুর্বৃত্ত কংস কৃষ্ণবলরামের বিনাশ সাধনে অকৃতকার্য হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শাশ্বত সত্যের প্রতীক। শান্তির উৎস। সত্যনিষ্ঠ এক মহান চরিত্র। বিশ্ব আজ জড়বাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বাহ্যিক চাকচিক্য তার অন্তর্জগৎকে তমাচ্ছন্ন করে তুলেছে। ফলে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মানুষ চায় এ অন্যায় ও অবিচার থেকে মুক্তি। তাই অনাদির আদি গোবিন্দ স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ অনুসরণ করাই আজ অপরিহার্য। আসুন জীবনবোধের এ মহাসত্য অনুসরণ করে জাতিভেদ, বর্ণভেদ আর কুসংস্কারের জঞ্জাল ধুয়েমুছে ফেলি। আমাদের পরিচয় হোক পৃথিবীর সকল মানুষ আমাদের ভাই। মানবতা আমাদের ধর্ম। সাধনা আমাদের মানব কল্যাণ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সহায় হোন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী এবং সভাপতি, জেলা আওয়ামী লীগ, ফরিদপুর
মন্তব্য করুন