খুব কাতর কণ্ঠে জো বাইডেন বলেছেন, 'তালেবান আমাদের সহায়তা করেছে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও বিদেশিদের প্রস্থানে।' পরদিনই ভয়ংকর ঘটনা। ইসলামিক স্টেটের বিধ্বংসী বোমায় ১৮২ জনের মৃত্যু। ১৪ জন মার্কিন সেনাও। তালেবান কোনো দায় নেয়নি। না নিলেও আইএস জঙ্গিরা কাবুলে ঢুকল কী করে? হাক্কানি গ্রুপ চুপ কেন? এসব প্রশ্ন নিয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো চুপ। মৌনী। ন্যাটের বহু সেনা এখনও কাবুলে। আগস্টের শেষে আফগানিস্তান থেকে ভালোয় ভালোয় নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারলে হাঁফ ছাড়বে। তারপর শুরু হবে আমেরিকার নতুন খেলা। নতুন চক্রান্ত। চক্রান্তের ধরন কী এখনও অজানা। কানার মনে মনেই জানা। অপমান গিলেতে পারে না কানা।

১৪ জুন ২০০৩ বার্লিনের শাউবুনে প্রেক্ষাগৃহে তারিক আলি এক বক্তৃতায় বলেন, 'আফগানিস্তানের মানুষ কোন ধাতুর, তালেবান কোন ধাতুর, ন্যাটো বিন্দুবিসর্গ জানে না। রাশিয়া জেনেছিল। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। গৃহকর্তার কাছে মিনতি, আগে কুকুর সামলাও ভিক্ষে চাইনে। আমেরিকা কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার দিচ্ছে, ভারী অস্ত্র, বিমান দিচ্ছে, ন্যাটোর ধনী দেশগুলোও দিচ্ছে, সব গোল্লায় যাবে। আফগানিস্তানে কুড়ি বছরও টিকতে পারবে না। পাততাড়ি গোটাবে।' তারিক আলির ভবিষ্যদ্বাণী হুবহু মিলে গেছে। তারিক আলির বক্তৃতার ওই অংশবিশেষ জার্মানির দ্বিতীয় টিভি চ্যানেল জেডিএফ প্রচার করেছে ১৮ আগস্ট, আফগানিস্তান নিয়ে বিশেষ টকশো অনুষ্ঠানে; রাতে। বক্তৃতায় অবশ্য জেডিএফের আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত। প্রচারিত।

লক্ষণীয়, আমেরিকা কোনো দেশে জয়ী হয়নি মূলত। ভিয়েতনামে যুদ্ধ বাদই দিলুম। কাপড় খুলে পালিয়েছে। সাইগন থেকে মার্কিন সৈন্যের পড়ি কি মরি পালানোর দৃশ্য, বিমানে ওঠার, আবার দেখলুম কাবুলের পতনের পরে; বিবিসির খবরে। সাধারণ আফগানদেরও। হৃদয়বিদারক। পাপের প্রায়শ্চিত্ত।

আমেরিকা দোষারোপ করছে গত কুড়ি বছরের আফগানিস্তান শাসকদের। অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ। নানা অভিধায়। আশ্চর্য! আমেরিকার রাষ্ট্রকর্তা, প্রশাসন, সিআইএ কি কিছুই জানত না? ন্যাটোর দেশগুলো জানত না? বিশ্বাস করব? ওদের অনুগত, কাছে নতজানু আফগান প্রেসিডেন্ট। আফগান প্রশাসনের কর্তাকুল। মার্কিন প্রশাসকদের নিত্যবেলায় সালামই দেয় না শুধু, উঠবসও করে। তাহলে?

গত পনেরো বছরে টিআই (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল) দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের ইনডেক্স তৈরি করে দেখিয়েছে আফগানিস্তানের অবস্থান পয়লা সারিতে। তার পরেও হুঁশ হয়নি? দেখা না-দেখার অকূল পাথারে বাস? চোখ অন্ধ? সেলাই করা মুখ?

জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থায় (ইউএনডিপি) কর্মরত ছিলেন জাহিদ হায়দার। বৎসরাধিক। আফগানিস্তানে। বিভিন্ন অঞ্চলে। এক লেখায় জানিয়েছেন, আফগান ও তালেবানের সঙ্গে আফিম ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন মার্কিন সেনাকুঞ্জের অনেকেই। বেতনের চেয়ে বেশি আয়। যাদের 'সেনা ট্রেনিং' দেওয়া হয়েছে, তাদেরও কেউ কেউ। প্রতিবাদ করলে আমাদেরই বিপদ। তালেবানের জাগরণে, মার্কিন সেনা, ন্যাটো সেনাদেরও ভূমিকা আছে। ভাত সেদ্ধ হয়েছে কিনা, চাল একটা টিপলেই জানা যায়। চালই টেপেনি মার্কিন প্রশাসন। আগুনে তা দিয়েছে (ডলার ঢেলেছে) ঠিকই। সেদ্ধ হয়নি ভাত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা মিত্রশক্তি বটে, কিন্তু বার্লিন দখল করে সোভিয়েত রাশিয়া। জার্মানির পূর্বাঞ্চলও। আমেরিকা নয়। যুদ্ধের পর পোসিডাম কনফারেন্স। আমেরিকা-রাশিয়া-ফ্রান্স-ব্রিটেনের রাষ্ট্রকর্তার সমাবেশ। কী করণীয়। শান্তিচুক্তি।

সপ্তাহ কয়েকও যায়নি, আমেরিকা কত শক্তিমান প্রদর্শন হিরোশিমায় পরমাণু বোমা ফাটিয়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা। বাড়িঘর তছনছ। ধ্বংস। পশ্চিম ইউরোপকে বুঝিয়ে দিল বেশি ট্যা-ফুঁ করবে না। না করার হুঁশিয়ারি দিয়ে জাপান, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালিসহ আরও তিনটি দেশকে মার্শাল প্ল্যানের আওতায়। অঢেল ডলার ঢেলে বিধ্বস্ত দেশ গড়া, কারখানা, শিল্প গড়া। সাহায্য। আমেরিকার পদতলে মনপ্রাণ সঁপে ন্যাটোয় যুক্ত।

মার্শাল প্ল্যানের অন্য ইতিহাসও আছে। সোভিয়েত রাশিয়া পূর্ব ইউরোপকে কবজা করছে, করেছে। অর্থ দিচ্ছে। সোভিয়েত রাশিয়ার থাকবে। অতএব, ডলার উজাড় করে পশ্চিম ইউরোপে। যত লাগুক। নো চিন্তা। পশ্চিম ইউরোপকে কমিউনিস্টমুক্ত করতে হবে। গণতন্ত্রী করতে হবে। সফল।

অসফল যুদ্ধে, দেশ জয় করেও। বার্লিনের ডাকসাঁইটে দৈনিক 'ডি টাৎস্‌'-এ রাজনৈতিক ভাষ্যকার হানস ডাটার মুইভার লিখেছেন :'ইরাক যুদ্ধে আমেরিকা জয়-পরাজয়ের চেয়ে অধিক। ইরাক এখন তিন ভাগে বিভক্ত। তিন গোষ্ঠীর অধীনে। কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন লবডঙ্কা। আমেরিকার মাতব্বরি ধূলিসাৎ। আমেরিকান দেখলেই একজন শিশুও তেড়ে আসে।'

তার লেখা পড়ে এক পাঠক, নাম মাবিয়া হেসলার, চিঠিপত্র পৃষ্ঠায় লিখেছেন : 'সিরিয়া, লিবিয়া যুদ্ধে জো বাইডেনই আসল কালপ্রিট। তিনিই তখন ওবামার বৈদেশিক নীতির পয়লা। তিনি সিরিয়া, লিবিয়া যুদ্ধের আয়োজক। হিলারি ক্লিনটনও সহযোগী। ধোয়া তুলসীপাতা নন, ওরা। রীতিমতন দোষী। ভুললে চলবে না, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীর অংশ ওরা।' তার চিঠির নিচের অংশ আরও বিস্ময়মাখা।

প্রশ্ন করেছেন- 'আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশ কেন ইসলামী দেশগুলোকে গণতন্ত্রের নামে টার্গেট করে? আরব স্প্রিং কেন ছড়িয়ে দেয়? হংকংকে কেন দেয় না? ভারতে কেন দেয় না? ইসরায়েলে কেন দেয় না? ইউরোপে কেন দেয় না? গণতন্ত্রের বুলি আউড়িয়েও কেন ইরানে, পাকিস্তানে পারছে না? সিআইএ কি কম চেষ্টা করেছে? আমেরিকার মতলব কি জানে না?'

আফগানিস্তান দখলের পর রাশিয়া আশা করেছিল আমেরিকা সহায়ক হবে। উল্টো। তালেবানকে সাহায্য। অর্থে। অস্ত্রে। এখন ঠেলা বোঝ। রাশিয়া প্রতিশোধ নিচ্ছে। ভূরাজনীতি রাশিয়া যত বোঝে, জানে, আমেরিকা বিন্দুমাত্র নয়। অস্ত্রের, অর্থের ঝনঝানিতে বিশ্বদাপট সাময়িক। রাজনীতি হয় না। অবুঝ আমেরিকা। এখনও।

বার্লিনের যে অঞ্চলে বাস করি, বার্লিনের অন্যতম দ্রষ্টব্য। নানা কারণে। সড়কের নাম আইজেন আখারস্ট্রাসে। একই সড়কের পাঁচ বিল্ডিংয়ের পরেই একটি তিনতলা বাড়িতে, তিন ঘর। ছয় আফগান ছাত্রীর বাস। বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশ। ডক্টরেট করছেন দু'জন। পরিচিত। প্রতিবেশী। ১৫ আগস্টে দেখা। লজ্জার বালাই নেই। জড়িয়ে ধরেন। হাউমাউ কান্না। 'তোমার মতো আমাদেরও দেশঘর নেই। মাতৃভূমি নেই। আমরাও উদ্বাস্তু। আমরাও আত্মীয়স্বজনহীন।' চোখ ভেসে যায় চোখের জলে।

বার্লিন প্রবাসী কবি