করোনা-দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সরকার ঘোষিত প্রণোদনার ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ আদান-প্রদানের ঘটনা নিন্দনীয় হলেও আমরা বিস্মিত নই। বস্তুত এই অতিমারিতেও দেশে নানা ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম ঘটেছে, এটি তার সাম্প্রতিকতম আবিস্কার। রোববার সমকালসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং তথা সানেমের জরিপে এসেছে, ঘুষ না দেওয়াসহ অন্যান্য কারণে জরিপের আওতায় থাকা ৭৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে এখনও ঋণ পায়নি। প্রণোদনা না পাওয়ার ক্ষেত্রে জরিপে ২৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান সরাসরি ঘুষের বিষয়টি উল্লেখ করলেও ৪৭ শতাংশ উত্তরদাতা একই প্রশ্নে 'হ্যাঁ' কিংবা 'না' কোনোটাই বলেননি। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ হিসেবে বলা যায়, এদের অনেকেই হয়তো ঘুষ দাবির মুখোমুখি হয়েছেন। আমরা দেখেছি, ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে বরাবরই ঘুষের অভিযোগ করা হয়। এমনকি গত বছরের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ঘুষবিরোধী ব্যবসায়িক সংগঠন ট্রেসের প্রতিবেদনে এসেছে, সরকারি খাতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঘুষের ঝুঁকি বেশি- এমন দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।
সরকারের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক লেনদেনে ঘুষের প্রাধান্যই এসেছে ট্রেসের প্রতিবেদনে। ব্যবসায়ীদের মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতেই যেখানে শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের প্রণোদনা, সেখানে অর্থছাড়ের জন্য ঘুষ দাবি করা হলে এর সুফল সংশ্নিষ্টরা পাবেন কীভাবে! দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন মেয়াদে লকডাউন, বিধিনিষেধসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তাতে উল্লেখযোগ্য সময় ধরে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। করোনাসৃষ্ট এ বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সরকার ঘোষিত এখন পর্যন্ত ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হচ্ছে স্বল্প সুদে ঋণ। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে চলমান মহামারির শুরু থেকেই সরকারের যে সদিচ্ছা আমরা দেখছি, ঘুষের লেনদেন নিঃসন্দেহে তাতে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে।
স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণের অর্থ বিতরণ করা হলেও যথাযথ প্রক্রিয়ায় দেওয়া হচ্ছে কিনা, সেটি তদারক করাও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ। সমকালের প্রতিবেদনে এসেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেছেন, তাদের কাছে ঘুষের কোনো তথ্য নেই। তারা প্রণোদনার আওতায় বিতরণ করা ঋণের সঠিক ব্যবহার বিষয়ে তথ্য যাচাইয়ের কাজ করছেন। আমরা মনে করি, তথ্য নেই বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ঋণের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটি যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখবে; একই সঙ্গে প্রণোদনার ঋণ কতজন ব্যবসায়ী পেয়েছেন, ঋণ পেতে সমস্যা কিংবা অনিয়ম হচ্ছে কিনা এটাও দেখা জরুরি। অভিযোগ রয়েছে, প্রণোদনার অর্থপ্রাপ্তিতে বড়রা এগিয়ে থাকলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের প্রতিষ্ঠান পিছিয়ে রয়েছে। অথচ প্রণোদনার ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের প্রতিষ্ঠানকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
আমরা জানি, এ ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠান করোনার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধের শঙ্কায় রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সানেমের জরিপ অনুযায়ী, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকেই বেশি ঘুষ চাওয়া হয়েছে। ঘুষ ছাড়াও জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে প্রণোদনার বাইরে রয়ে গেছে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। অথচ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই প্রণোদনার দাবি ওঠে এবং সরকার ব্যবসায়ীদের কল্যাণে সে দাবি মেনে নেয়। প্রত্যাশিত প্রণোদনা পেয়েও যদি ব্যবসায়ীরা তার সুফল না পান এবং অনিয়মের কারণে অর্থ তুলতে না পারেন, তবে এ প্রণোদনা দিয়ে কী লাভ।
করোনায় সৃষ্ট সংকটে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার একটি জরুরি করণীয়। দেশের স্বার্থেই সরকারকে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে। আমরা চাই, ঘুষের অভিযোগ আমলে নিয়ে যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। একই সঙ্গে প্রণোদনা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া সহজ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা স্বচ্ছতার মাধ্যমে প্রদান এবং প্রাপ্ত অর্থ যথাযথ খাতে ব্যয় করার মাধ্যমেই করোনায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
মন্তব্য করুন