আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব 'কান'-এ বাংলাদেশের গৌরবময় উপস্থিতি ও পারফরম্যান্স বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মুখ সমুজ্জ্বল করেছে এবং তা অনেকের গাত্রদাহের কারণ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের টিভি নাটক ও ধারাবাহিক নাটকগুলোর অসাধারণ জনপ্রিয়তা ও মাস শেষে মিলিয়ন মিলিয়ন লাইক অনেক আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, যা বহু রাষ্ট্রের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং যথারীতি তারা মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। 'মুনিয়া আত্মহত্যা' প্রথমেই সে সুযোগ তৈরি করে দিল। শুরু হলো 'সুপার স্ট্রাকচার'-এর 'পাওয়ার প্লে'! সে তার শক্তির উপস্থিতিও জানান দেওয়াটা অস্তিত্বের জন্য জরুরি মনে করল।
সম্প্রতি আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর লেখা, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তার লেখা পড়ে কিছু প্রশ্ন জাগল। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর কলম এমনিতেই ওঠার কথা নয় এবং নিশ্চয়ই কোনো গভীর পর্যবেক্ষণ রয়েছে বলে মনে হলো। তার বক্তব্যের সঙ্গে কয়েকটি ব্যাপারে একমত পোষণ করি। কোনো মানুষ দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে তাকে দোষী বলা যাবে না, তার পেশাগত অবস্থান ও সুনাম ক্ষুণ্ণ করা যাবে না, তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও সংবিধান প্রদত্ত রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কিন্তু আমরা পরীমণির ক্ষেত্রে কী দেখতে পেলাম? পরীমণিকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া নিয়ে একটি ইভেন্ট তৈরি করা হলো এবং সংবাদমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়ল। কথা হলো, কেউ আইন ভঙ্গ করলে তার শাস্তি অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু লঘু পাপে গুরু দণ্ড দেওয়া নীতিগতভাবে সিদ্ধ নয়। বোট ক্লাবের পুরুষ সেলিব্রেটিরা সংগোপন ও নীরব প্রক্রিয়ায় যেভাবে পার পেয়ে যাচ্ছেন, পরীমণির ক্ষেত্রে সেটা ঘটল না। তাই সর্বগ্রাসী দাবানল থেকে দেশের চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে অন্যান্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নারীদের 'নারী' হিসেবে ডিসক্রিমিনেট না করার জন্য আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীকে কলম ধরতে হলো।
সাংস্কৃতিক সম্ভাবনার এ প্রস্ম্ফুটনের সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, নাটক ও সংস্কৃতির যেখানে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া দরকার, আগে যেখানে প্রায় ১৫০টি চলচ্চিত্রকে সরকারিভাবে অর্থায়ন করা হতো, বর্তমানে কমিয়ে ৩০টির মতো করা হলো কেন? এমনিতেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চলচ্চিত্রের নায়িকাদের প্রতি এক ধরনের সুপ্ত নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা হয়। অনেকের ধারণা, বিভাগীয় শহরগুলোর রাজনৈতিক নেতা, করপোরেট কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের বাসায় এ রকম অভিযান শুরু হলে অনেক বারের সন্ধান বের হয়ে আসবে। নির্ধারিত ফি কিংবা টাকার বিনিময়ে বৈধ লাইসেন্সের ব্যবস্থা তো আইনগতভাবেই দেওয়া আছে। নাইট ক্লাব, বোট ক্লাব, ডিপ্লোম্যাটিক ক্লাবগুলোতে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের অবাধে যাওয়া-আসা ও লাইসেন্সবিহীন সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। তাহলে আইন কি সবার জন্য সমান নয়? পরীমণিকে নিয়ে বিন্দুকে কেন সিন্ধু বানানো হলো? নারীর প্রতি জনগণকে খেপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এমনি এক পরিস্থিতিতে, যখন ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে বাংলা নাটকের মান আকাশচুম্বী। এমন পরিস্থিতিতে বাংলা নাট্যজগৎও ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। এরই মধ্যে ব্যাপারটি কলকাতার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
করপোরেট কালচারের সদস্য তো অনেকেই শুধু উৎপাদনযন্ত্রের হাতিয়ার। উপযোগিতা শেষ, আপনিও শেষ। চয়নিকা চৌধুরীকে নিয়ে যা হলো, তা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। আইন যদি নিজস্ব গতিতে চলত, কথা ছিল না। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী তার লেখায় অনেক বিষয় তুলে এনেছেন এবং প্রশ্ন রেখেছেন। এসব প্রশ্ন এড়ানোর পথ নেই। দায়িত্বশীল সবার সতর্কতাই কাম্য।
লেখক, প্রশিক্ষক

বিষয় : প্রশ্নগুলো

মন্তব্য করুন