
সময় মানুষকে এগিয়ে দেয়। আবার সময় মানুষকে সেই নিরিখে তৈরিও করে। যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল, এর পেছনে ছিল বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার ও প্রত্যয়। এর অনেক কিছু আমরা অর্জন করলেও, এখন পর্যন্ত অনার্জিত রয়ে গেছে আরও কিছু। এই কলামেই লিখেছিলাম, আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়ার জন্য সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের পাশাপাশি অতি জরুরি লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা। সন্দেহ নেই, বিগত পাঁচ দশকে অর্থনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর উন্নয়ন-অগ্রগতি কম নয়। তারপরও প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার দেয়াল অনেক ক্ষেত্রেই ভাঙা যায়নি। নারীর নিরাপত্তা আজও প্রশ্নের বিষয়। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নারীর অংশগ্রহণ নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যহারে বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রা স্পর্শে এখনও আমরা অনেক দূরে।
তবুও স্বস্তির বিষয়, বর্তমান সরকারের নারীবান্ধব অনেক নীতিই আশার আলো দেখাচ্ছে। সরকারের নির্বাহী প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেষ্ট এবং তার দিকনির্দেশনায় সরকারের নারীবান্ধব নীতি যখন ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তখন আমাদের দায়িত্বশীল কারও কারও বৈরী আচরণ কিংবা অর্বাচীনতা বিস্মিত না করে পারে না। আর তা যদি হয় জাতীয় সংসদের মতো দেশের উচ্চ কোনো ফোরামের সদস্য কর্তৃক, তাহলে তা আরও বেশি বিস্ময়, যুগপৎ উদ্বিগ্ন না করে পারে না। ৫ সেপ্টেম্বর সমকালের প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন এই গৌরচন্দ্রিকার কারণ। আকার ও আঙ্গিকে প্রতিবেদনটি ছোট হলেও, তা সঙ্গতই ক্ষুব্ধ করেছে। একই সঙ্গে প্রতিবাদী করে না তুলেও পারেনি। 'চাকরিজীবী নারী-পুরুষের বিয়ে বন্ধে এমপির প্রস্তাব' শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বগুড়া-৭ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু চাকরিজীবী নারী বা পুরুষ একে অন্যকে বিয়ে করতে পারবে না- এমন বিধান রেখে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছেন। তার যুক্তি- বেকারত্ব কমানো ও গৃহকর্মীদের দ্বারা শিশু নির্যাতন বন্ধে তা প্রয়োজন। কী বিস্ময়কর মন্তব্য!
আমরা অনেকেই মনে করি, এমন জ্ঞান-বিবেচনাহীন লোকজন জাতীয় সংসদের মতো দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসার অনুপযুক্ত। একজন আইনপ্রণেতার এমন বক্তব্যের জন্য জাতীয় সংসদের স্পিকারের বিধি মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াও প্রয়োজন মনে করি। দেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতাসহ রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই অনেক নারী সরাসরি যুক্ত। জাতীয় সংসদে সরাসরি নির্বাচিত ও সংরক্ষিত আসনেও নারী সংসদ সদস্যের সংখ্যা কম নয়। তা ছাড়া প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ব্যাংক খাতসহ রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি অনেক খাতেই উচ্চ থেকে নিম্ন পদ পর্যন্ত কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। লিঙ্গ বৈষম্যের নিরসন করে সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার নিরন্তর ধারাবাহিক সংগ্রামের অংশীদার আমরা অসংখ্যজন। এ অবস্থায় যে আইনপ্রণেতা অদ্ভুত ও অচিন্তনীয় প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উত্থাপন করলেন, তা সভ্যতা-মানবতার কলঙ্ক। এমন আইনপ্রণেতা দিয়ে আমরা কী করব? তারা জনকল্যাণ নয়, নিজেদের কল্যাণ ও হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতেই তৎপর এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়াটাও দুর্ভাগ্যের।
সুযোগে জাতীয় সংসদের সদস্যপদ লাভ করা এমনজন নির্বাচিত হওয়া এবং তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে শুভবোধসম্পন্নরা লজ্জিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। এমন প্রস্তাবের ঘটনা আমরা হেসে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতেই পারতাম। কিংবা এ নিয়ে লেখা বা বলারও কিছুই থাকত না, যদি তিনি একজন সংসদ সদস্য না হতেন। জাতীয় সংসদ চলে জনগণের অর্থে। এই জাতীয় সংসদে বসে রেজাউল করিম বাবলুর মতো 'জনপ্রতিনিধিরা' বেফাঁস মন্তব্য করে, প্রস্তাব উপস্থাপন করে কিংবা আলোচনার নামে জনঅর্থ নাশ করতে পারেন না। একজন সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদে যে কোনো বিষয়ে আলোচনার অধিকার রাখলেও নিশ্চয় তিনি সভ্যতা-মানবতাবিরোধী ও অপ্রাসঙ্গিক কোনো বিষয়ে আলোচনা করার অধিকার রাখেন না। তিনি কি ভুলে গেলেন জাতীয় সংসদের ভাবগাম্ভীর্য কিংবা ওখানে আলোচ্য বিষয়ের গুরুত্ব? তিনি অতীতেও তার নেতিবাচক মন্তব্যের জন্য অত্যন্ত নিন্দিত হয়েছিলেন। নিকট অতীতে দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ব্যাপকতা ক্রমেই বাড়ছিল এবং এই প্রেক্ষাপটে সরকার কঠোর আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। প্রস্তাবিত ওই আইনের বিধান নিয়ে জাতীয় সংসদে যখন আলোচনা হচ্ছিল, তখন আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন সে আলোচনায় অংশ নিয়ে।
তার এমন কাণ্ড সমাজবিরোধীদের উৎসাহ জোগানোয় সহায়ক। তখন তার ওই মন্তব্য নিয়ে নানা মহলে ব্যাপক আলোচনা হলেও তার তাতে কোনোই বোধোদয় ঘটেনি। এ সংসদ সদস্যেরই প্রায় এক বছর আগে পিস্তল হাতে হাসিমুখের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তুলেছিল। সংবাদমাধ্যমেই দেখেছিলাম তার এসব ঘটনার পর ক্ষুব্ধ জনপ্রতিক্রিয়া। জাতীয় সংসদের অভিভাবকের এসব জনপ্রতিক্রিয়া আমলে নেওয়া দরকার। সেই কবে মহীয়সী বেগম রোকেয়া নারীকে ডাক দিয়েছিলেন ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে বের হয়ে এসে সামাজিক পরিমণ্ডলে নিজেদের স্বার্থ ও প্রয়োজনে, দেশ-সমাজের বৃহৎ স্বার্থে যুক্ত হয়ে নিজেদের সেভাবে গড়ে তোলার। রেজাউল করিম বাবলুর মতো লোকরা কীভাবে জনরায় নিয়ে জাতীয় সংসদের মতো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পরিসরে বসার সুযোগ পান- এমন প্রশ্নে আমাদের অনেকেরই সচেতনতার ঘাটতির বিষয়ও সামনে নিয়ে আসে। তাদের মতো পেছনমুখী চিন্তার কেউ যাতে আইনপ্রণেতার কাতারভুক্ত না হতে পারেন, এ জন্য জনসচেতনতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকেও তাদের প্রার্থী মনোনয়নে সজাগ-সতর্ক থাকতেই হবে।
যদিও আইনমন্ত্রী এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন তখনই, কিন্তু রেজাউল করিম বাবলুর প্রস্তাব সংবিধানেরও পরিপন্থি। আমরা জানি, আমাদের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমাদের সংবিধান রক্তস্নাত। এই সংবিধান তৈরির প্রেক্ষাপট ও আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের অধ্যায় কত বিস্তৃত ও ঐতিহাসিক, তা রেজাউল করিমের মতো সংসদ সদস্যদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে অজানা থাকলেও দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর কাছে এসবই ইতিহাসের অক্ষয় অধ্যায়। আমাদের দেশের নারীরা আজ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগ দিয়ে গৃহবিবাদে বিপর্যস্ত দেশগুলোতে শান্তিরক্ষা কাজের মতো মহান ব্রতে ব্রতী। এ আমাদের গৌরবের আরেকটি অধ্যায়। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের নারী সমাজের এত ঔজ্জ্বল্যের মাঝে একজন সংসদ সদস্যের অবিমৃষ্যকারী মন্তব্য বিস্ময়কর, যুগপৎ প্রশ্নবোধকও। আধুনিক এই যুগেও একজন সংসদ সদস্যের আদিম যুগবাসীর মতো প্রস্তাব নিঃসন্দেহে গোটা সমাজের জন্যই অবমাননাকর। সংবিধান, রাষ্ট্রীয় নীতি, সামাজিক অঙ্গীকার তার মন্তব্য সহ্য করতে পারে না।
সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু প্রলাপ বকেছেন বলে মোটেও মনে করি না। তার মনোভাবের প্রকাশ অজ্ঞানতাপ্রসূতও নয়। অতীত এবং বর্তমান সাক্ষ্য দেয়- তার অন্তরে লুকিয়ে থাকা পশ্চাৎপদ চিন্তা, প্রতিক্রিয়াশীলতার ভূত, কূপমণ্ডূকতারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। তবে এ কথা মনে রাখা উচিত, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই বাংলাদেশকে হীনচেষ্টাকারীরা কখনোই পেছনে ঠেলে দিতে পারবে না। তাদের এও মনে রাখা উচিত, সর্বাগ্রে পরিচয় মানুষ; নারী-পুরুষ লিঙ্গ নির্ধারক পরিচয়মাত্র। যে অর্গল ভেঙে এ দেশের নারীরা অগ্রযাত্রার সড়কে পা রেখেছেন, সেখান থেকে তাদের টেনে নামানোর অপচেষ্টা যারাই করবেন, এ সমাজ তাদেরই প্রত্যাখ্যান করবে। সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলুর বক্তব্য কোনোভাবেই যুক্তিসম্মত নয়। এ হলো নিতান্তই অশুভ ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না।
কথাসাহিত্যিক
মন্তব্য করুন