কোনো নাগরিক মোবাইল ফোনের একটি সিম নিবন্ধন করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই অন্যের অপরাধ সংঘটন সহজ করে দিচ্ছেন কিনা, একটি এনআইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে একাধিক সিম ব্যবহারের বিধান চালুর সময়ই এ প্রশ্ন উঠেছিল। মঙ্গলবার সমকালে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদনের ভাষ্যে সেই আশঙ্কাই সত্য প্রমাণ হয়েছে। সিটিটিসি তথা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের অনুসন্ধান সূত্রে দেখা যাচ্ছে- নিবন্ধনকারী নিজের জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে একটি মাত্র সিম ব্যবহার করলেও তার অজান্তেই একই এনআইডি দিয়ে সক্রিয় রয়েছে একাধিক মোবাইল সিম। এসব সিম ব্যবহার করে সংঘটিত হচ্ছে নানা প্রতারণা, হুমকি ও মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা কিংবা অর্থ পাচারের মতো অঘটন। আমরা মনে করি, এভাবে ছোট অসতর্কতায় বড় অপরাধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। এতে করে নিছক ব্যক্তির হয়রানি ও বিড়ম্বনা নয়; রাষ্ট্র ও সমাজের জন্যও সৃষ্টি হচ্ছে সামষ্টিক ঝুঁকি। বিশেষত মোবাইল ব্যাংকিংসহ আর্থিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন প্রক্রিয়া যখন নাগরিকের 'হাতের মুঠোয়' চলে আসছে, তখন এ ধরনের ঝুঁকি সার্বিক ডিজিটালাইজেশনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। খানিকটা বিলম্বে হলেও বিষয়টি যে সামনে এসেছে সে জন্য সিটিটিসি সাধুবাদ পেতে পারে। এখন মনোযোগ দিতে হবে এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দিকে। এক্ষেত্রে প্রথমেই নজর দিতে হবে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সুরক্ষিত রাখার দিকে। আমাদের মনে আছে, ২০১৬ সালে দেশের সক্রিয় সব সিমের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সূচিত হয়েছিল। আমাদের এও মনে আছে, ওই বছর জুলাই মাসেই কয়েকজন 'খুচরা' সিম বিক্রেতাকে আটক করা হয়েছিল নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় এ ধরনের জালিয়াতির কারণে। তখনও এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা সতর্ক করে দিয়েছিলাম যে, বিপুল সংখ্যক সিম সীমিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধন করতে গিয়ে নিরাপত্তা ও সতর্কতার বিষয়টিতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। বিষয়টি এখনও আমলে নেওয়া যেতে পারে বৈকি। এ ধরনের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সুরক্ষিত রাখতে হবে যে কোনো মূল্যেই। সেক্ষেত্রে মোবাইল কোম্পানিগুলোকেও স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষভাবে জোর দিতে হবে জনসচেতনতার দিকে। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সচেতন নাগরিকই যে উত্তম প্রহরী, এই আপ্তবাক্য অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, মোবাইল ফোন বা সিমের মাধ্যমে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যম হিসেবে অজ্ঞাতসারে ব্যবহূত হয়ে থাকে প্রান্তিক মানুষেরাই। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, বিশ্বে যেখানে বেশিরভাগ সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয় প্রতিরোধ ব্যবস্থার বিচ্যুতির কারণে, সেখানে বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের মূল কারণ জনঅসচেতনতা। এর অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্ভেদ্য। আমরা দেখেছি, কীভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিল একটি আন্তর্জাতিক চক্র। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা বেশি নয়। বরং অনেক বেশি ব্যক্তিগত হয়রানি ও কুৎসা। আমরা আশঙ্কা করি, জালিয়াতির নিবন্ধনের মাধ্যমে সচল সিমগুলোর একটি বড় অংশের শিকার হয় মেয়েরা। এর 'রাজনৈতিক' প্রেক্ষিতও গুরুত্বপূর্ণ। একশ্রেণির নেটিজেনের অসচেতনতার কারণে অনলাইনে গুজব ছড়িয়ে অফলাইনে হিংসাত্মক ঘটনার জন্ম কীভাবে হয়, তা আমরা কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং বগুড়ার শাজাহানপুরে দেখেছি। গত অর্ধযুগে দেশের বিভিন্ন থানায় কমবেশি চার হাজার সাইবার অপরাধের অভিযোগও এ ধরনের অপরাধের ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি প্রমাণ করে। অস্বীকার করা যাবে না যে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাইবার অপরাধ দমনে আগের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় ও দক্ষ হয়েছে। একই সঙ্গে জনসচেতনতা বাড়ানো না গেলে অসচেতনতার কারণে সংঘটিত অপরাধ দমন করে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া যাবে না। কে না জানে যে, রোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। সেই কাজটি সিম নিবন্ধন জালিয়াতি বন্ধের মধ্য দিয়েই সূচিত হোক। যে জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে সিম নিবন্ধনে জালিয়াতি চলে, সেটাও আরও সুরক্ষিত করা যায় কীভাবে, দীর্ঘমেয়াদে ভাবতে হবে।
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২১ । ০০:০০ । প্রিন্ট সংস্করণ
মন্তব্য করুন