উন্নত দেশগুলোতে সর্বাধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক সেবা থাকার পরও করোনার তীব্র প্রকোপের সময় তারা যেভাবে অসহায় ছিল, সেখানে আমাদের মতো দেশগুলোর অবস্থা অনুমেয়। উন্নত দেশের সঙ্গে আমাদের মতো দেশের মৌলিক ব্যবধান হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সেবার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা। বিশাল জনসংখ্যার এ দেশে প্রায় দুই হাজার ৫০০ মানুষের জন্য একজন ডিগ্রিধারী চিকিৎসক আছেন। একই সঙ্গে হাসপাতাল, সেবিকা ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রেও ঘাটতি অনেক। প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দ যথেষ্ট না হলেও কম নয়, কিন্তু চাহিদার তুলনায় অনেক কম। সরকারি হাসপাতালগুলো প্রতিদিন হাজারো রোগীর সেবা দিলেও অসংখ্য মানুষকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মানসম্পন্ন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক, নার্সসহ ২৩ জন স্বাস্থ্যকর্মীর একটি দল থাকা দরকার।
স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অর্জন কম নয়, কিন্তু চিকিৎসা অব্যবস্থাপনা রয়েই গেছে। শহর এলাকার মানুষ তুলনামূলকভাবে বেশি সুবিধা পেয়ে থাকলেও গ্রাম এলাকার চিত্র ভিন্ন। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে রোগীর নিজস্ব ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। পরিসংখ্যান বলে, বাংলাদেশে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ রোগীকে বহন করতে হয়। এর মধ্যে কেবল রোগ নির্ণয়ের জন্যই উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করতে হয়। ২০৩২ সালে রোগীর নিজস্ব ব্যয় ৩২ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ প্রতিবছর রোগীর নিজস্ব ব্যয় বেড়েই চলেছে।
বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, দেশের অনেক হাসপাতালে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি, অ্যাম্বুলেন্স পড়ে আছে। অনেক যন্ত্র বছরের পর বছর বাক্সবন্দি হয়ে আছে, কখনও খোলাই হয়নি। আবার অনেক ক্ষেত্রে লোকবল বা মেরামতের অভাবে সেগুলো ব্যবহার হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের যোগসাজশের কথাও শোনা যায়। কেননা, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও টেকনোলজিস্টরাই তো বেসরকারি কেন্দ্রগুলোতে অর্থের বিনিময়ে কাজ করেন। ফলে সাধারণ রোগীদের সেবা পেতে বেসরকারি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে হয়। বিশেষ করে গ্রাম ও মফস্বল এলাকার রোগীদের ভোগান্তির শেষ নেই। দূরদূরান্ত থেকে শহরে আসা রোগীদের চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পেতে ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে কতটা কষ্ট ও অর্থ ব্যয় করতে হয়, তা ভুক্তভোগীরাই ভালো বোঝেন। এমনও হয়, শহরে এসে থাকতে হয়, ফলে চিকিৎসা ব্যয়ের চেয়ে যাতায়াত ও থাকার খরচ বেশি হয়।
সরকার প্রতিবছর শতকোটি টাকা খরচ করছে আধুনিক চিকিৎসাসামগ্রী কেনার জন্য। সংগত কারণেই প্রশ্ন জাগে, লোকবল বা মেরামতের সুযোগ যদি না থাকে, তাহলে কার স্বার্থে এত যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এটা কি অপরিপকস্ফ পরিকল্পনার ফল, নাকি অন্যকিছু? যারা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের কি নূ্যনতম দায়িত্ববোধ নেই? সাধারণ মানুষের করের টাকায় কেনা কোটি কোটি টাকার যন্ত্র যদি তাদের সেবায় কাজে না লাগে, তাহলে আমাদের অর্থ অপচয়ের দায় কে নেবে? এভাবে জনগণকে অবহেলা, অবজ্ঞা করা এবং তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে খেলা করার অধিকার কারোর নেই। নীতিনির্ধারক ও দায়িত্বশীলরা কি একবারও ভাবেন, চিকিৎসার জন্য এ দেশের একজন গরিব কৃষক বা দিনমজুরকে কী করতে হয়? তাদের ক্ষেতের ফসল বা হালের বলদ বিক্রি করে, পরিবারকে উপোস রেখে চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। কেবল চিকিৎসার জন্য কত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে ও হচ্ছে এর হিসাব কে রাখে।
জনগণের কষ্টের টাকার এমন অপব্যবহার রোধ করা আবশ্যক। এত যন্ত্রপাতি অব্যবহূত থাকার কারণ অনুসন্ধানের সঙ্গে সঙ্গে ক্রয়ের সঙ্গে সম্পৃক্তদের জবাবদিহিতার ক্ষেত্রটি তৈরি করা দরকার। একই সঙ্গে বেসরকারি রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের জন্য ফি সুনির্দিষ্ট করা হোক। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও টেকনোলজিস্টদের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কাজের জন্য নীতিমালা ঠিক করা হোক। আর যে কোনো নতুন যন্ত্র ক্রয়ের আগে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি অগ্রাধিকার দেওয়া হোক, যাতে এর সঠিক ব্যবহার হয়।
শিক্ষক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট