
তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপি গ্যাসসহ অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্যের মূল্য নির্ধারণের এখতিয়ার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসির। তিনটি প্রবিধান দ্বারা এসব পণ্যের মূল্য নির্ধারণ হওয়ার কথা। এসব প্রবিধান ২০১২ সালে জ্বালানি বিভাগে জমা দিয়েছে বিইআরসি। এখন পর্যন্ত সেগুলো মন্ত্রণালয়েই আটকে আছে। ফলে বিইআরসি গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করেনি। এতে ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছামতো মূল্যে বাজারে এলপিজি বিক্রি করেছে। এতে ভোক্তারা প্রতারিত হন। এই ব্যবসায়ীরা যখন-তখন মূল্যহার বাড়াতেন। আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে এলপিজির মূল্যহার বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে তারা মূল্য বৃদ্ধি করেছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন মূল্যহার কমেছে তখন তারা সে হারে মূল্য কমাননি।
দীর্ঘদিন এভাবেই চলে আসছিল। বিইআরসি যেন এলপিজির মূল্য নির্ধারণের আদেশ করে- এই নির্দেশ চেয়ে ২০১৬ সালে উচ্চ আদালতে একটি মামলা হয়। এ মামলায় ২০২০ সালে উচ্চ আদালত বিইআরসিকে মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার আদেশ দেন। সে অনুযায়ী বিইআরসি মূল্য নির্ধারণ শুরু করে। ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল বিইআরসি এলপিজির মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। তবে বিইআরসি যে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়, বাজারে তা বাস্তবায়ন হয়নি। বরং ব্যবসায়ীরা বারবার তাদের ইচ্ছামতো মূল্য নির্ধারণ করছেন। বিইআরসি নির্ধারিত এলপিজির বর্তমান বাজার মূল্য ১০৩৩ টাকা। কিন্তু বাজারে কোথাও ১১০০ টাকা, কোথাও ১১৫০ টাকা, আবার কোথাও ১২০০ টাকায় এলপিজি কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
বিইআরসি এলপিজির যে মূল্য নির্ধারণ করছে তা সঠিক ছিল কিনা সে বিষয়টি বিচার-বিশ্নেষণ করা যেত, যদি সেই মূল্য বাজারে বাস্তবায়ন হতো। যেহেতু বিইআরসি নির্ধারিত মূল্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না, শুধু কাগুজে ডকুমেন্ট হিসেবেই থেকে যাওয়ায় ভোক্তার ওপর কোনো প্রভাব ফেলছে না; সুতরাং মূল্য নির্ধারণ করা না করার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব বহন করে না। কাজেই এই মূল্য কার্যকর করার বিষয়ে বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। বিইআরসির আদেশ বাস্তবায়ন করা গেলে ১০০-১৫০ টাকা কমে ভোক্তারা এলপিজি সিলিন্ডার পেত। যদি এ আদেশ বাস্তবায়ন হতো তাহলেই কেবল মাসে মাসে মূল্য নির্ধারণ সঠিক হচ্ছে কিনা, অথবা বিকল্প কোনো উপায়ে মূল্য সমন্বয় করা যায় কিনা, সে বিষয়গুলো চিন্তা করা যেত।
ব্যবসায়ীরা বলছেন তারা ২০১১-১২ সালে ১১০০ টাকায় একটি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করতেন। ২০২১ সালে তারা সেই সিলিন্ডার ১১৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। তাহলে বুঝতে হবে ২০১১-১২ সালে একেকটি সিলিন্ডার ১১০০ টাকায় বিক্রি করে তারা কী পরিমাণ লাভ করেছেন। যখন মূল্য নির্ধারণ ছিল না তখন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ভোক্তারা কী পরিমাণ ঠকেছে তা ব্যবসায়ীদের বক্তব্য থেকেই অনুমান করা যায়। ব্যবসায়ীরা গণশুনানিতে বলেছেন, তারা এলপিজির সর্বোচ্চ মূল্য চান। কিন্তু বিইআরসির প্রবিধানমালা অনুযায়ী, নূ্যনতম মূল্যে মানসম্মত ও নিরবচ্ছিন্ন এলপিজি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে তার আদেশ দ্বারা। এলপিজি বাজারে পাওয়া যায় ১১০০ টাকায়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এখন চাচ্ছেন ১৩৮০ টাকা। বাজারে যে দামে বিক্রি হয় তার চেয়ে বেশি দাম চাওয়া বা বেশি দামে বিক্রি করা বা বেশি মূল্য নির্ধারণ করা প্রতিযোগিতা আইন অনুযায়ী একধরনের অপরাধ। অর্থাৎ একদিকে তারা বিইআরসি নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে এলপিজি বিক্রি করছেন, অন্যদিকে সেই অধিক মূল্যের চেয়েও আরও মূল্য বৃদ্ধির জন্য বিইআরসিকে চাপ দিচ্ছেন। তাদের এসব কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণভাবে বিইআরসি আইন এবং প্রতিযোগিতা আইনের পরিপন্থি।
২০২১ সালের ১২ এপ্রিল গণশুনানির ভিত্তিতে বিইআরসি এলপিজির মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। ওই সময় ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল- মূল্যহার ১২৫৯ টাকা নির্ধারণ করার। বিইআরসি তার প্রবিধানে নির্ধারিত ও নির্দেশিত পদ্ধতি অবলম্বন করে এলপিজির মূল্য নির্ধারণ করেছিল ৯৭৫ টাকা। গত ১৩ তারিখের গণশুনানিতে এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা চেয়েছিলেন এলপিজির মূল্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্ধারণ করতে হবে। সেভাবেই মূল্যহার নির্ধারণ হয়েছে। কিন্তু তারা যে মূল্য নির্ধারণ করেছিলেন অর্থাৎ ১৩৮০ টাকা নির্ধারণ না হলে তারা মানবেন না- এমন অবস্থানে তারা আছেন। তাদের এই মূল্যহার না রেখে বিইআরসি নতুন করে যে মূল্যহার নির্ধারণ করছে তা বিদ্যমান ১০৩৩ টাকার চেয়েও কম হওয়ার কথা। এলপিজির নূ্যনতম মূল্যহার অনুযায়ী ক্যাবের হিসাবে যা ৯৯৭ টাকা হতে হবে। কিন্তু বিইআরসি সেটিকে বর্ধিত করে ১০৯৭ টাকায় নিয়ে গেছে। এর মাধ্যমে বিইআরসি তার নিজের আইন ও বিধিবিধান লঙ্ঘন করেছে। বিইআরসি ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী মূল্যহার নির্ধারণ করতে পারে না। এরকম একটি প্রস্তাব বিইআরসির গণশুনানিতে উত্থাপন করা হয়েছে। আমরা বলেছি, এই প্রস্তাব আইনসম্মত নয়। আর এলপিজি ব্যবসায়ীরা ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল নির্ধারিত মূল্যের যে পরিবর্তন কিংবা সংশোধন চেয়েছেন, সেটাও আইনানুগ নয়। সুতরাং গণশুনানিতে তারা যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন তা বাতিল করা হোক এবং বিইআরসি নির্ধারিত ১০৩৩ টাকা মূল্যহার অপরিবর্তিত রাখা হোক। যদি এই মূল্যহার পরিবর্তন করা হয় তাতে আমাদের আপত্তি থাকবে। এ বিষয়টি ইতোমধ্যে আমরা আদালতের নজরে এনেছি। আদালত আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গণশুনানির ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন। আমরা বলেছিলাম, গণশুনানি করে বিইআরসি নিজেই তার নিজের আদেশ লঙ্ঘন করার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাবে। এতে বিইআরসির নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং ভোক্তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে। সেই বিষয়টি গণশুনানিতে প্রমাণ হয়েছে। বিইআরসি ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব অনুযায়ী মূল্যহার ১০৩৩ থেকে ১০৯৭ টাকায় নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছে।
বিইআরসিতে মূল্যহার সংশোধনীর প্রস্তাব দেওয়া হলে তা পুনর্বিবেচনা করার বিধান আছে। তবে মূল্যহার কার্যকর থাকাকালীন এ প্রস্তাব আসতে হবে এবং মূল্যহার নির্ধারণের তারিখ থেকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে আনতে হবে। কিন্তু তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের প্রস্তাব আনেননি। এমনকি মূল্যহার ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বলবৎ থাকাকালীনও তারা আবেদন করেননি। সুতরাং ব্যবসায়ীদের আবেদন করা এবং বিইআরসি কর্তৃক সেই আবেদন গ্রহণ করা উভয়ই আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত হয়েছে। সুতরাং এই প্রস্তাব খারিজযোগ্য এবং খারিজ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আবেদনকারী যদি যৌক্তিক ও ন্যায্য কারণ দেখিয়ে তথ্য-প্রমাণ ও বিচার-বিশ্নেষণ দ্বারা মূল্যহার পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রস্তাবটি গণশুনানিতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, তাহলে মূল্যহার পরিবর্তনের বিষয়টি বিইআরসি বিবেচনা করতে পারে। কিন্তু আবেদনকারী গণশুনানিতে কোনো তথ্য-উপাত্ত পেশ করতে পারেনি। তারা কেবল কিছু স্টেটমেন্ট দাখিল করে মূল্য সংশোধনের প্রস্তাব করেছিল। তবে, এসব স্টেটমেন্টের পরিপ্রেক্ষিতে তারা কোনো দালিলিক প্রমাণ দেয়নি। অর্থাৎ তাদের প্রস্তাব কোনো অবস্থাতেই যৌক্তিক প্রমাণিত হয়নি। সুতরাং সেই প্রস্তাবে মূল্যহার সংশোধনের এখতিয়ার বিইআরসির নেই।
ইতোপূর্বে বিইআরসি বিভিন্ন সময় যে মূল্যহার নির্ধারণ করেছে বা আদেশ দিয়েছে, এলপিজি লাইসেন্সিরা কোনো মূল্যহার বা আদেশ বাস্তবায়ন করেননি। বিইআরসি আইন অনুযায়ী যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এলপিজি লাইসেন্সিদের বিরুদ্ধে আমরা এই অভিযোগ উচ্চ আদালত এবং বিইআরসিতে দায়ের করেছি। উচ্চ আদালতে যা বিচারাধীন রয়েছে। এমতাবস্থায় মূল্যহার পরিবর্তন করে মূল্যহার না মানার অভিযোগ থেকে তাদের দায়মুক্ত করার যে প্রয়াস বিইআরসি নিয়েছে, সে কারণেও মূল্যহার পরিবর্তনে আমাদের আপত্তি রয়েছে। সুতরাং এলপিজি লাইসেন্সিদের প্রস্তাব বাতিল না করে এবং ভোক্তা স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে বিইআরসি যদি নির্ধারিত মূল্যহার পরিবর্তন করে তাহলে এটাই প্রমাণ হবে যে, বিইআরসি নিজেই তার আইন-আদেশ লঙ্ঘন করছে।
শিক্ষাবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
মন্তব্য করুন