
ভারতের পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট 'ডিভোর্সের পর বাচ্চা কার কাছে থাকবে'- এমন একটি প্রশ্নে যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন গত ২ জুন ২০২১। এ বিষয়ে আদালত বলেছেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর নৈতিক চরিত্রের প্রতি আঙুল তোলা সহজ। যদি সত্যিই কারও বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক থাকে, তাহলেও এ সিদ্ধান্তে আসা যায় না- সন্তানের হেফাজত তাকে দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ এশিয়ার দেশগুলোতে যেখানে মায়ের অন্য সম্পর্ক সব সময়ই সন্তানের হেফাজত হারানোর অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়, সেখানে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ আমাদেরকে মাতৃত্ব সংক্রান্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধারণাটি ফিরে দেখার কথা মনে করিয়ে দেয়।
পাশ্চাত্যে বিষয়টি একটু ভিন্নভাবেই দেখা হয়। সেখানে বিয়ে বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে আইন নারীর পক্ষেই থাকে। রাষ্ট্রের দায় থাকে একক মায়ের সন্তানের প্রতি। গৃহহিংসার আইনেও সেখানে নারীর স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে রাষ্ট্র বাচ্চার জন্য একাকী মাকেই অনুদান দেয়। দুর্ভাগ্যবশত এ ব্যবস্থাটি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে অনুপস্থিত। এখানে নারীবান্ধব আইন দূরে থাক; নারী ও পুরুষের সমানাধিকারই এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ডিভোর্সকামী অনেক মেয়েকে এখনও এখানে ট্রমার মধ্যে দেখা যায়- হয়তো প্রতিশোধস্পৃহাতেই বর (স্বামী) বাচ্চাকে কেড়ে নেবে নানা সত্য-মিথ্যা যুক্তি সাজিয়ে। মাতৃত্ব যে একটি চয়েস বা বেছে নেওয়ার অধিকার- এটা এখনও মেনে নিতে পারেনি আমাদের দেশের সমাজ। 'সন্তান চাইছি', 'সন্তান চাইছি না', 'এ মুহূর্তে চাইছি না', 'শারীরিক কারণে পেরে উঠছি না', 'নিজস্বতা বজায় রেখেই একলা মা হতে চাইছি'- নারী স্বাধীনতার এই অমোঘ বক্তব্যগুলো রাষ্ট্র এখনও মেনে নিতে প্রস্তুত হয়নি। বাচ্চা না হওয়ার কারণে এখনও এদেশে নারীকে নিগৃহীত হতে হয়। এমনকি সন্তান দিতে পারে না বলে নারীর বিয়ে বিচ্ছেদ একটি স্বাভাবিক সামাজিক বিধান বলেই মেনে নেওয়া হয়। অনিচ্ছাকৃত সন্তানহীনতা এখনও সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে আমাদের দেশের নারীদের ভীষণ পীড়িত করে। প্রভাব পড়ে শরীর ও মনে।
সন্তান-সুখের দাম কত? নিঃসন্তান মা-বাবা সেই সুখের ভাগীদার হতে কত দূরে যেতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাব নিয়ে সামনে এসেছে পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেন। টাকা ফেললেই সন্তান, ছেলে বা মেয়ে যা চাই! এদেশ যেন শিশু তৈরির কারখানা! সন্তান উৎপাদনে অক্ষম বাবা-মায়েরা সারোগেসির মাধ্যমে আত্মজর স্বপ্টম্ন পূরণ করছে এখানে। পরিষেবা বুঝে দিতে হয় মূল্য। তবে উপযুক্ত মূল্য দিলে সন্তান ধারণের হেন কোনো পরিষেবা নেই, যা পাওয়া যাবে না ইউক্রেনে। অর্থের বিনিময়ে সন্তান ধারণের পরিষেবা বিশ্বের কয়েকটি দেশ দিতে পারলেও ইউক্রেন সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান উৎপাদনকে পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে ইউক্রেনে এ শিল্প এতটাই বেড়েছে যে, গোটা দুনিয়ার কাছে এখন দেশটির পরিচিতি 'শিশু উৎপাদনের কারখানা' নামে। বিদেশি বাবা-মায়ের জন্য প্রতি বছর সারোগেসি প্রক্রিয়ায় অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার সন্তানের জন্ম হয় ইউক্রেনে। ভারত ও থাইল্যান্ড আইন করে বিদেশিদের জন্য সন্তান ধারণের বাণিজ্যিক সুবিধা বন্ধ করে দেওয়াতেই ইউক্রেনে এ শিল্পের ভাগ্য খুলেছে বলে অনেকের ধারণা। সাধারণত ইউক্রেনে সারোগেসির মাধ্যমে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার নূ্যনতম খরচ ২৫ হাজার ইউরো। তবে তা বাড়তে পারে ৭০ হাজার ইউরো পর্যন্ত। চাইলে পুত্র সন্তান বা কন্যা সন্তানের জন্যও চেষ্টা করতে পারে সন্তানেচ্ছু বাবা-মা। সে সুযোগ করে দেয় ইউক্রেন। তবে তার জন্য অতিরিক্ত মূল্য দিতে হয়। রোজগারের লক্ষ্যে ইউক্রেন ধাত্রী মায়েদের গর্ভ ভাড়া দেয়।
বন্ধ্যত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে বন্ধ্যত্বের শাপমুক্তি ঘটছে বর্তমান সময়ে। ২৫ জুলাই সারাবিশ্বে পালিত হয় 'ওয়ার্ল্ড ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন ডে', যা সহজভাবে পরিচিত 'নবজাতক দিবস' হিসেবে। এবারের এদিনে সুপ্রজনন বিদ্যার অদৃশ্য জয়ধ্বজা উড়িয়েছেন পৃথিবীর অনেক বিশেষজ্ঞই। ১৯৭৮ সাল থেকে বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় আইভিএম-কে শেষ অবলম্বন হিসেবে গণ্য করা হয়। আজ এ চিকিৎসার চিত্রটা বেশ সহজ এবং সফলযুক্ত। বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় এখন অবলম্বন করা হচ্ছে অ্যাকটিভ ম্যানেজমেন্টের পন্থা। যারা প্রচণ্ড আন্তরিকভাবে সন্তান চাইছে, তাদের কাছে প্রতিটি চলে যাওয়া সপ্তাহ যেন হতাশার দীর্ঘশ্বাস! বর্তমানে এ চিকিৎসার প্রথা-প্রকরণ পাল্টেছে, আরও সহজ হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, দম্পতিরা যদি যথাসময়ে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেয়, চিকিৎসার অত্যাধুনিক অগ্রগতি এতটাই বলীয়ান যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বর্তমানে বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে। অধিকাংশের সমস্যা সমাধান হলেও তার মধ্যে সামান্য সংখ্যক দম্পতি থাকে, যাদের সাফল্য নিবিড়-ঐকান্তিক সেরা চিকিৎসাতেও অধরা থেকে যেতে পারে। তাদের জন্যই হয়তো ইউক্রেনের সন্তান উৎপাদন শিল্প দিনের পর দিন বড় বাণিজ্যিক সফলতা এনে দিচ্ছে।
টাকা ফেললেই সন্তান পাওয়া যাবে, সুচিকিৎসা দিতে পারলেই বন্ধ্যত্ব ঘোচানোর রাস্তা বের হয়ে আসবে- এসব হয়তো সম্ভব। কিন্তু এর কোনোটাই তো আমাদের দেশের অসহায় মাতৃত্বের পরিচিতি ঘুচিয়ে দিতে পারছে না। মাকে দেবী মানা যাচ্ছে, পবিত্র ও ছায়াদায়ী ভাবা যাচ্ছে; মায়ের কোলে শুয়ে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে, মায়ের মুখ দেখলে সব দুঃখ সয়ে নেওয়া যাচ্ছে; বিদ্যাসাগরের জীবন বাজি রেখে ভরা দামোদর নদী সাঁতরে পাড়ি দেওয়ার ইতিকথাও মেনে নেওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সেই মাকে অসহায় ভাবা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাপারটা এ রকম- মায়ের সব আছে, আবার মায়ের কিছুই নেই। নারীর এ অবস্থান থেকে মুক্তি মেলার কোনো লক্ষণ নেই। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও নারী স্বাতন্ত্র্যের পরিপন্থি। নারীর এই যে 'ভালো মা' হয়ে ওঠার মূর্তির আদর্শ, সেখানে পৌঁছতে গিয়ে তাদের মধ্যে সহযোগিতার বদলে প্রতিযোগিতা গড়ে ওঠে। নারীরাই মা হিসেবে অন্য নারীর ব্যর্থতা বিচার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নারী তাই 'ভালো মা' হতে পারছে; কিন্তু মানুষ হিসেবে অধিকার ভোগ করতে পারছে কি?
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
ceo@ilcb.net
মন্তব্য করুন