পরিবেশ দূষণ, দুর্গন্ধ- এসব যেন চামড়া শিল্পের সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে। অথচ স্বাধীনতা প্রাপ্তির অনেক আগে থেকেই যে শিল্পের বিকাশ, সেটা তো আজকে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে প্রতিনিধিত্বকারী শিল্প হওয়ার কথা ছিল। নিজস্ব কাঁচামাল, সস্তা শ্রমিক আর স্বল্প উৎপাদন খরচ, কী ছিল না আমাদের? কিন্তু এত কিছুর পরেও বাংলাদেশের চামড়া শিল্প আজ অস্তগামী। একটু পেছনে তাকালে দেখা যায়, ১৯৮৬ সালে সরকার ৯০৩টি দূষণকারী কারখানাকে (হাজারীবাগ ট্যানারিসহ) তিন বছরের মধ্যে তাদের দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলে ১৯৯১ সালে স্থানান্তরের প্রশ্নে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয় এবং ১৯৯৩ সালে ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তর করা হবে- এ মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে স্থানান্তর শেষ করা হবে এই লক্ষ্যে 'ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রি টাউন-সাভার, ঢাকা' (পরে 'ঢাকা ট্যানারি এস্টেট') নামে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। দফায় দফায় সময় বাড়ানোর পর সরকার ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। যেখানে ব্যুরো অব রিসার্চ টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশন (বিআরটিসি), বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত প্রযুক্তিগত শাখা, সাভারের প্রস্তাবিত ঢাকা ট্যানারি এস্টেটের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) পরামর্শক হিসেবে কাজ করে। তারা সিইটিপি প্রকল্পের পরিবেশ, কাঠামোগত, ভিত্তি, রাসায়নিক, বৈদ্যুতিক এবং যান্ত্রিক কাজের তত্ত্বাবধান করে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধস্তন সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এখনও ১৯৯.৪০ একর জমিতে পুরো 'ঢাকা ট্যানারি এস্টেট' প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে।
চীন-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগের কোম্পানি, জেএলইপিসিএল-ডিসিএল ট্যানারি এস্টেটে সিইটিপি এবং ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ করেছে। নিঃসন্দেহে এসব কিছুই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। ঠিক এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। অথচ শিল্পনগরীর সব সুবিধা নিশ্চিত না করে ট্যানারিগুলোকে বারবার স্থানান্তরের সময়সীমা বেঁধে দিতে থাকে শিল্প মন্ত্রণালয়। তাতেও কাজ না হওয়ায় উচ্চ আদালত হাজারীবাগের কারখানাগুলোর গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আদেশ দেওয়ার পর ২০১৭ সালের এপ্রিলে কারখানাগুলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও একযোগে স্থানান্তরিত হয়। সিইটিপির বিভিন্ন কম্পোন্যান্টের কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই ১৩০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন শুরু করলে সাভারে ধলেশ্বরী নদীতে ট্যানারিগুলোর বর্জ্য ও দূষিত তরল মিশতে শুরু করে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ভাষ্যমতে, সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে দৈনিক ৪০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদন হলেও সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা রয়েছে মাত্র ২৫ হাজার ঘনমিটারের। তাছাড়া, শুধু তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা থাকলেও হেভি মেটাল এবং ক্রোমিয়াম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেই।
গত ২৩ আগস্ট পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না হওয়ায় সাভারের চামড়া শিল্পনগরী আপাতত বন্ধ রাখা এবং শিল্পনগরী বন্ধের আগ পর্যন্ত জরিমানার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ আদায় করার সুপারিশ করে। স্বাভাবিকভাবেই এই জরিমানা আদায় করা হবে বিসিক থেকে। বিসিক পরবর্তী সময়ে এই জরিমানা আদায় করবে ট্যানারিগুলোর কাছ থেকে এবং একসময় শিল্পনগরীটি বন্ধ হবে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আরও বলেছে, ভবিষ্যতে আইনের ধারা অনুযায়ী কমপ্লেক্সটি পরিচালিত হলে ফের চালু করার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। অন্যদিকে ট্যানারির প্রক্রিয়ার দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, কাঁচা চামড়া থেকে পাকা চামড়া করতে ১৮ থেকে ২১ দিন সময় লাগে। আর এজন্যই অন্যান্য উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে ট্যানারিগুলো আলাদা ও স্বতন্ত্র। এ ধরনের অনন্য একটি শিল্পকে সাময়িক বন্ধের সুপারিশ কতটা আর্থিক ক্ষতিসাধন করতে পারে, ভেবে দেখা দরকার।
হাজারীবাগে অপরিকল্পিতভাবে ট্যানারিগুলো যখন ছিল, তখনও এই শিল্পের রপ্তানি আয় ছিল ২৩২.৬ মিলিয়ন ডলার (এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো, অর্থবছর ২০১৬-১৭)। অথচ, এত বিনিয়োগ ও একটি পরিকল্পিত শিল্পনগরীতে স্থানান্তরের পর রপ্তানি আয় এসে দাঁড়ায় ১৮৩ মিলিয়ন ডলারে (এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো, অর্থবছর ২০১৭-১৮)। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সমগ্র চামড়া শিল্পের রপ্তানি আয়ে ট্যানারিগুলোর ভূমিকা ৪৬ শতাংশ ছিল, তা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় মাত্র ১৬ শতাংশে। এই যাত্রা নিম্নগামী হতে হতে বন্ধের পথে। আর এমনটা হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আরও দুটি (চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে) চামড়া শিল্পনগরী স্থাপনের কথা বলেছেন, সেগুলোর বাস্তবায়ন কিছুটা হলেও বাধাপ্রাপ্ত হবে।
এই শিল্পকে নিয়ে কি দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনার সময় আসেনি? ঠিক কী কী কারণে একটা পরিকল্পিত শিল্পনগরী ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো? কী করলে এই শিল্পনগরীকে তার সমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করা যায়- এসব ভাবা দরকার। এ ক্ষেত্রে বিসিক ও ট্যানারি-সংশ্নিষ্ট সংগঠনগুলকে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করা উচিত। এই শিল্পনগরী বন্ধ না করে কীভাবে স্বল্পতম সময়ে পরিবেশবান্ধব করা যায়, তা নিয়ে কাজ করা দরকার। শিল্পনগরীকে বন্ধ না করে পরিবেশবান্ধব করার আগ পর্যন্ত জরিমানার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ আদায় করে তা পরিবেশ দূষণ হ্রাস প্রকল্পে কাজে লাগানো যেতে পারে। সম্পূর্ণ শিল্পনগরীটিকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে আলাদা আলাদা ইটিপি/সিইটিপি নির্মাণ পরিকল্পনাও করা যেতে পারে। পাশাপাশি গাছ লাগানোকেও প্রাধান্য দিতে হবে। পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি ট্যানারিগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিবেশের মান বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন '৯৫ ও বিধিমালা '৯৭ অনুযায়ী বজায় রাখতে হবে। এর সবকিছুই একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে বা করতে হবে।
চামড়া শিল্পকে নিয়ে যে কোনো দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এই শিল্প সম্পর্কিত একাডেমিক এবং পেশাদার পরামর্শকের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাশিত ফলাফলে বড় ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস রাখি। তা না হলে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েও আমরা ভুলের গোলকধাঁধায় রয়েই যাব।
প্রভাষক, ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়